আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। আবহাওয়া, বয়স এবং অন্যান্য অনেক কারণে আমাদের ত্বকে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে থাকে। এ কারণে ত্বক ডিহাইড্রেটেড এবং নিষ্প্রাণ দেখায়। ডিহাইড্রেটেড স্কিন থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকরী যে উপাদানটি, সেটি হলো টোনার।
ত্বকের খেয়াল রাখতে গেলে প্রাথমিক কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ক্লিনজিং, টোনিং ও ময়েশ্চারাইজিং। এই তিনটি ধাপ মেনে না চললে ত্বককে ভাল রাখা কোন ভাবেই যায় না। কিন্তু অনেকেই রয়েছেন যারা এই ন্যূনতম খেয়ালও ত্বকের রাখেন না। দিনে দু’বার ফেসওয়াশ ব্যবহার করলেও টোনার ব্যবহার করার কথা ভুলে যান অনেকেই। কিন্তু টোনার ব্যবহার না করলে বাড়তে পারে ত্বকের সমস্যা। ত্বক গভীরভাবে পরিষ্কার হয় না, রোমকূপ পরিষ্কার হয় না। পাশাপাশি বাড়ে ব্রণর সমস্যা। তাই এই আর্টিকেলে আমরা টোনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
টোনার :
টোনার হচ্ছে একটি দ্রুত-অনুপ্রবেশকারী তরল যা ত্বককে দ্রুত হাইড্রেশন সরবরাহ করে এবং ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে কিছু মৃত কোষ অপসারণ করতে সাহায্য করে থাকে । আপনার ত্বকের গভীরে গিয়ে ত্বকের ময়লা পরিষ্কার করে, আপনার সংকুচিত ত্বককে করবে মসৃণ এবং তরতাজা।
টোনারের উপাদান :
টোনার এর ওয়াটারি অংশটুকু আপনার ত্বক খুব সহজেই শুষে নেয়, যার ফলে ত্বককে আরো প্রাণবন্ত দেখায়।টোনার আর হাইড্রেটর এর মতো হাইড্রেটিং প্রোডাক্ট গুলো আমাদের ত্বকে পানির পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে থাকে ।বেশিরভাগ টোনারই হিউমেকটেন্ট বা এসেনশিয়াল ওয়েল এর মতো সক্রিয় উপাদান দিয়ে তৈরি। হিউমেকটেন্ট পরিবেশ থেকে ত্বকে পানি নিয়ে আসে । অর্থাৎ এটি স্কিনে পানিকে আটকে রাখে। হায়ালুরনিক এসিড এর মতো হিউম্যাক্ট্যান্ট আর্দ্র আবহাওয়াতে দুর্দান্ত কাজ করে।
ত্বকের যত্নে টোনার কেন প্রয়োজন:
টোনারের মূল কাজ হচ্ছে ত্বকের পিএইচ (pH) কে ব্যালেন্স করা। কিন্তু কী এই pH? pH বা পটেনশিয়াল অফ হাইড্রোজেন (Potential of Hydrogen) ত্বকের অ্যাসিডিক বা অ্যালকালাইনের মাপকাঠিকে বলা হয়। অ্যাসিডিক মানে হচ্ছে অম্লীয় এবং অ্যালকালাইন মানে হচ্ছে ক্ষারীয়। ০-১৪ পর্যন্ত মাপের স্কেল দ্বারা এটি পরিমাপ করা হয়। মানুষের ত্বকে সেবামের পিএইচ সাধারণত ৪.৫ থেকে ৫.৫ পর্যন্ত থাকে, যা স্কেল অনুযায়ী অ্যাসিডিক। এই ন্যাচারাল স্কিন অ্যাসিডিটি ত্বককে ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে থাকে এবং এই পিএইচের ব্যালেন্সের উপর নির্ভর করে আমাদের ত্বকের সুস্থতা।
টোনার কেন ব্যবহার দরকার :
শীত, গ্রীষ্ম, কিংবা বর্ষা সকল ঋতুতেই আমাদের ত্বকের উপর দিয়ে বেশ ধকল যায়। সারাদিনের পরিশ্রম ও ধুলাবালিতে লাবণ্য হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় ত্বক। নিস্তেজ ত্বকে সহজেই জীবাণুর সংক্রমণ হয়, দেখা দেয় নানা রকমের সমস্যা।
তাই আমাদের চেহারায় রূপ-লাবণ্য ফুটিয়ে তোলা, তারুণ্য ধরে রাখা, সর্বোপরি ত্বকের সুস্থতার জন্য চাই এর নিয়মিত পরিচর্যা, দরকার একটি বেসিক স্কিন কেয়ার রুটিনের। এই বেসিক স্কিন কেয়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে ত্বকের টোনিং করা।
ত্বকের টোনিং করার ফলে কি কি সুবিধা পায় তা আমরা অনেকেই জানি না, ফলে অনেকেই টোনিং করাকে স্কিন কেয়ার এর রুটিন থেকে বাদ দেয়। টোনার ব্যবহারের ফলে আপনার ত্বকের কি কি উপকার পাবেন তা দেওয়া হলো-
- ক্লিঞ্জিং করার পরেও আপনার ত্বকে যদি কোনো ইম্পিওরিটি থেকে যায় তাহলে তা দূর করতে সাহায্য করে টোনার ।
- ক্লিঞ্জিং এর কারণে আপনার লোমকূপগুলোর মুখ যখন খোলা অবস্থায় থাকে।টোনার তা বন্ধ করতে সাহায্য করে।
- টোনার ত্বকের তৈলাক্তভাব নিয়ন্ত্রন করে।
- ত্বকের পি.এইচ ভারসাম্য বজায় রাখে টোনার।
- ময়েশ্চারাইজার গ্রহণের জন্য ত্বককে প্রস্তুত করে।
- ত্বকে পানির পরিমাণ বজায় রাখে।
টোনার ব্যবহারের নিয়ম :
টোনার ব্যবহার করার সঠিক নিয়ম মেনে চলা খুবই জরুরি। প্রথমে আপনার মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে । তারপর, একটি তুলার বল বা প্যাডে টোনার নিন এবং তা মুখের উপর হালকাভাবে ম্যাসাজ করতে হবে । চোখের আশেপাশের এলাকা এড়িয়ে চলুন। টোনার শুকানোর পর ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
পরিচ্ছন্ন মুখ:
প্রথমে একটি জেন্টল ক্লিনজার ব্যবহার করে মুখ পরিষ্কার করুন। এটি ত্বকের ময়লা, তেল এবং মেকআপ দূর করতে সাহায্য করে। ক্লিনজিংয়ের পরে ত্বককে শুকিয়ে নিন।
টোনার প্রয়োগ:
একটি তুলার বল বা প্যাডে টোনার নিন এবং তা মুখের উপর হালকাভাবে ম্যাসাজ করুন। ত্বকের সার্কুলার মুভমেন্টে ম্যাসাজ করুন যাতে টোনার ত্বকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। চোখের আশেপাশের এলাকা এড়িয়ে চলুন।
ময়শ্চারাইজার প্রয়োগ:
টোনার শুকানোর পর ত্বকে ময়শ্চারাইজার প্রয়োগ করুন। এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং ত্বককে নরম ও মসৃণ করে থাকে ।
টোনার ব্যবহারের উপকারিতা:
টোনার ব্যবহারের অনেক উপকারিতা রয়েছে। এর কিছু প্রধান উপকারিতা নিচে দেওয়া হল-
- ময়লা ও তেল দূর করে:
- টোনার ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে ময়লা ও তেল দূর করে এবং ত্বককে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে থাকে ।
- মেকআপ রিমুভাল:
টোনার ত্বক থেকে মেকআপ দূর করতে সাহায্য করে এবং ত্বককে সতেজ রাখে।
- পোর পরিষ্কার রাখা:
টোনার ত্বকের পোরগুলো পরিষ্কার রাখে এবং ব্রণ ও অন্যান্য ত্বকের সমস্যার ঝুঁকি কমিয়ে থাকে ।
- ত্বকের পিএইচ লেভেল বজায় রাখা:
ত্বকের প্রাকৃতিক পিএইচ লেভেল বজায় রাখতে সাহায্য করে টোনার।
- হাইড্রেশন:
কিছু টোনার ত্বককে হাইড্রেট করে এবং ত্বকের শুষ্কতা কমায়।
- ব্রণ প্রতিরোধ:
নিয়মিত টোনার ব্যবহার ত্বকের পোরগুলো পরিষ্কার রাখে এবং ব্রণ ও অন্যান্য ত্বকের সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে থাকে ।
ঘড়োয়া পদ্ধতিতে টোনার :
ঘরে তৈরি টোনার ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং নিরাপদ হয় । এখানে কিছু ঘরোয়া টোনার তৈরির পদ্ধতি দেওয়া হল-
- আপেল সিডার ভিনেগার টোনার:
এক চামচ আপেল সিডার ভিনেগার ও দুই কাপ পানি মিশিয়ে একটি সহজ ও কার্যকর টোনার তৈরি করা যায়। এই মিশ্রণটি ত্বকের পিএইচ লেভেল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে ।
- শসার রস এবং গোলাপ জল টোনার:
শসার রস এবং গোলাপ জল মিশিয়ে একটি প্রাকৃতিক টোনার তৈরি করতে পারেন। এটি ত্বককে সতেজ ও হাইড্রেট রাখে ।
- গ্রিন টি টোনার:
এক কাপ গ্রিন টি এবং এক চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে টোনার তৈরি করুন। গ্রিন টি ত্বকের প্রদাহ কমায় এবং আপেল সিডার ভিনেগার ত্বকের পিএইচ লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।
- মুলতানি মাটি টোনার:
এক চামচ মুলতানি মাটি এবং এক কাপ গোলাপ জল মিশিয়ে একটি টোনার তৈরি করুন। এটি তৈলাক্ত ত্বকের জন্য বেশ উপকারী।
- অ্যালোভেরা জেল টোনার:
অ্যালোভেরা জেল এবং গোলাপ জল মিশিয়ে একটি হাইড্রেটিং টোনার তৈরি করুন। এটি ত্বককে শীতল ও হাইড্রেট করে থাকে ।
টোনারের ধরন:
ত্বক পরিচর্যার অন্যান্য পণ্যের মতো টোনারও ত্বকের ধরন বুঝে ব্যবহার করতে হয়।তৈলাক্ত, শুষ্ক অথবা সাধারণ- ত্বকের ধরন বুঝে টোনার বাছাই করতে হবে। একই ভাবে ঠাণ্ডা মাসগুলোতে আর্দ্রতা রক্ষাকারী টোনার ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়। আবার ত্বকের ধরন বুঝে ও টোনার বেছে নিতেহবে ।
ক্ল্যারিফাইয়িং:
ব্রেক আউট ও দাগছোপের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে ক্ল্যারিফাইয়িং টোনার। এর প্রধান কাজ হল ত্বকে অস্বস্তি সৃষ্টি না করা। যদি মৃদু ও আর্দ্রতা রক্ষাকারী উপাদান সমৃদ্ধ টোনার ব্যবহার করতে চান যা ব্রণের বিরুদ্ধে কাজ করে তাহলে ক্ল্যারিফাইয়িং টোনার বাছাই করা যায়।
ময়েশ্চারাইজিং
ভারী, মিল্কি, গাঢ় টোনার শুষ্ক ও সংবেদনশীল ত্বকের জন্য উপকারী বলে জানান, ডা. টার্নার।এগুলো সাধারণত আর্দ্রতা রক্ষাকারী ও ত্বক ভালো রাখে এবং উপাদান যেমন- হায়ালুরনিক অ্যাসিড, উদ্ভিজ্জ তেল ও সেরামাইড দিয়ে তৈরি।
এক্সফলিয়েটিং
কার্যকারিতার ভিত্তিতে এক্সফলিয়েটিং টোনার দৈনিক বা সপ্তাহিক ভিত্তিতে ব্যবহার করতে হয়। এরা আলতোভাবে ত্বকের উপরিভাগ এক্সফলিয়েট’য়ের মাধ্যমে মৃত কোষ দূর করে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
“এক্সফলিয়েটিং টোনার ব্যবহার করতে চাইলে নির্দিষ্ট রাসায়ানিক উপাদানের দিকে নজর দেওয়া উচিত যা ‘এক্সফলিয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। যেমন- ল্যাক্টিক অ্যাসিড এবং পিএইচএএস মৃদু এক্সফলিয়েশন করে। অন্যদিকে গ্লাইকোলিক অ্যাসিড ও স্যালিসাইলিক অ্যাসিড কড়াভাবে কাজ করে”- বলেন ডা. টার্নার।
সুদিং
সুদিং টোনার ত্বকের অস্বস্তি ও জ্বলুনি কমাতে সহায়তা করে। এতে থাকে আরামদায়ক উপাদান যেমন- সিসা (সেনটেলা অ্যাসিয়াটিকা), গোলাপ জল বা অ্যালোভেরা।
টোনার ব্যবহারের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। সকাল ও সন্ধ্যার ত্বকের ধরন ও প্রয়োজন বুঝে টোনার ব্যবহার করতে হবে।
টোনার এর দাম:
বিভিন্ন দামের টোনার বাজারে পাওয়া যায়। টোনারের দাম নির্ভর করে তার ব্র্যান্ড, উপাদান এবং কার্যকারিতার উপর। সাধারণত ভালো মানের টোনারের দাম ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে । ত্বকের ধরন অনুযায়ী সঠিক টোনার নির্বাচন করে ব্যবহার করুন।
ব্র্যান্ড অনুযায়ী দাম:
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টোনার পাওয়া যায় যেমন নিট্রোজেনা, গার্নিয়ার, ল্যাকমে ইত্যাদি। ব্র্যান্ড অনুযায়ী টোনারের দাম ভিন্ন হয়।
উপাদান অনুযায়ী দাম:
টোনারের উপাদান অনুযায়ী দাম পরিবর্তিত হহয়ে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদান সমৃদ্ধ টোনারের দাম সাধারণত বেশি হয়।
কার্যকারিতা অনুযায়ী দাম:
টোনারের কার্যকারিতা অনুযায়ী দাম পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে ব্রণ প্রতিরোধক বা হাইড্রেটিং টোনারের দাম সাধারণত বেশি হয়।
টোনার ব্যবহারের সময় কিছু দিকে নজর দেওয়া জরুরি:
- ত্বকে পানি লাগানোর পরপরই টোনার লাগাতে হবে।
- টোনার লাগানোর জন্য তুলার প্যাড বা মিস্ট বোতল ব্যবহার করুন।
- টোনার লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে ফেলবেন না। পাঁচ থেকে সাত মিনিট অপেক্ষা করেময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে ফেলুন। তাহলে যে উদ্দেশ্যে টোনার লাগানো, সেটা পূরণ হবে।
আরো পড়ুন :ইমামের পিছনে নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম।
পরিশেষে:
বলা যায় যে ,টোনার ত্বকের যত্নের একটি অপরিহার্য অংশ যা ত্বকের পিএইচ লেভেল বজায় রাখতে এবং ত্বককে সতেজ রাখতে সাহায্য করে থাকে । সঠিক টোনার নির্বাচন এবং ব্যবহারের নিয়ম মেনে চললে ত্বক সুস্থ ও উজ্জ্বল থাকবে। টোনার ব্যবহারের পর ভিটামিন সি সিরাম প্রয়োগ করলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বক আরও মসৃণ ও স্বাস্থ্যবান হয়। টোনার ব্যবহারের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। সকাল ও সন্ধ্যার ত্বকের ধরন ও প্রয়োজন বুঝে টোনার ব্যবহার করতে হবে।আশা করছি টোনার সম্পর্কে আপনাদের আর কোনো দ্বিধা থাকবে না।