আসসালামু আ’লাইকুম। আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভাল আছেন।আকিকা সন্তানের জন্য অত্যান্ত জুরুরি।সন্তানের আকিকা দেয়ার দায়িত্ব পিতার- মাতার। আকিকা সম্পর্কে জানাটা আমাদের সকলের উচিত। তাই আজ আমরা এই আর্টিকেলটিতে আকিকা সম্পর্কে জানবো।
আকিকা :
আকিকা একটি আরবি শব্দ। আকিকা শব্দের অর্থ কর্তন করা বা কেটে ফেলা । মুসলমানদের জন্য আকিকা সুন্নত। আকিকাকে সুন্নতে মু’আক্কাদাহ বা নিশ্চিত সুন্নত বলা হয়। শিশুর জন্ম উপলক্ষে পশু জবাই করাকে আকিকা বলে।
হজরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত , হজরত মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াত লাভের পরে নিজের আকিকা নিজে করেছিলেন। (বায়হাকী) সঠিক নিয়মে আকিকা দেয়া হয় নবজাতক সন্তানের বলা মুছিবত দূর করার জন্য এবং আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায়ের জন্য।
আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত:
আকিকার নির্দেশ স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন নাতি হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন(রাঃ)র আকিকা করেছেন ।এবং তিনি বলেছেন, ছেলে মেয়ের জন্য আকিকা দিতে । এদের পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত করাও এবং এর মাধ্যমে ময়লা ( মাথার চুল) দূর করো । (সহীহ বুখারী )
তিনি আরো বলেছেন প্রত্যেক শিশুরই আকিকা জরুরী । (আবু দাউদ, হাদীস নং ২৮৪০ মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ২০০৯৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত যে , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ইহুদিরা শুধু পুত্র সন্তানের আকিকা করত । কিন্তু কন্যা সন্তান আকিকা করত না । তোমরা পুত্র সন্তানের জন্য দুটি ছাগল এবং কন্যা সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে হলেও আকিকা করো । (বায়হাকি, সুনানে কুবরা: ১৯৭৬০; মুসনাদ বাযযার: ৮৮৫৭)
আকিকা সঠিক নিয়মে করা হলে এর মাধ্যমে সন্তানের বিপদ আপদ দূর হয় । সবচেয়ে বড় উপকার হলো আকিকার মাধ্যমে কেয়ামতের দিন পিতা-মাতা-সন্তানের সুপারিশের উপযুক্ত হয় ।
এছাড়াও আকিকার মাধ্যমে দানশীলতার বিকাশ ঘটে । গরিব মিসকিন ও আত্মীয় স্বজনের কিছুটা হলেও হক আদায় করা যায় । বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সম্পর্ক বাড়ে এবং পরস্পরে আন্তরিকতাপূর্ণ ভালোবাসা সৃষ্টি হয় ।
আকিকা সম্পর্কে হাদীস:
আকিকা সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস রয়েছে। যেমন –
عن جعفر بن محمد عن أبيه أنه قالوزنت فاطمة بنت رسول الله صلى الله عليه وسلم شعر حسن وحسين وزينب وأم كلثوم فتصدقت بزنة ذلك فضة
হযরত যাফর বিন মুহাম্মদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা বলেছেন হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান , হযরত হুসাইন , হযরত জয়নব ও হযরত উম্মে কুলসুমের চুল ওজন করে সেই পরিমাণ রুপা সদকা করে দিয়েছেন । ( মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-১৮৩৯, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৮২৬২, সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৯০৭৯)
সালমান বিন আমের দাব্বী রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
«مَعَ الْغُلَامِ عَقِيقَةٌ فَأَهْرِيقُوا عَنْهُ دَمًا وَأَمِيطُوا عَنْهُ الْأَذَى»
‘পুত্র সন্তানের সঙ্গে আকীকা রয়েছে। সুতরাং তার পক্ষে রক্ত প্রবাহিত করো এবং তার থেকে কষ্ট দূর করো।’ [বুখারী : ৫০৪৯; তিরমিযী : ১৫১৫; মুসনাদ আহমদ : ১৭৯০৭।]
সামুরা বিন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«كُلُّ غُلاَمٍ رَهِينَةٌ بِعَقِيقَتِهِ تُذْبَحُ عَنْهُ يَوْمَ سَابِعِهِ وَيُحْلَقُ وَيُسَمَّى»
‘প্রত্যেক শিশুই তার আকীকা জরুরী। জন্মের সপ্তম দিনে তার জন্য জবাই করা হবে এবং তার মাথা নেড়ে করা হবে আর নাম রাখা হবে। [আবূ দাউদ : ২৮৪০; মুসনাদ আহমদ : ২০০৯৫।]
উম্মে কুরয আল-কা‘বিয়া রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি,
«عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ شَاةٌ».
‘ছেলে সন্তানের পক্ষে সমবয়সী দু’টি ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষে একটি ছাগল (দিয়ে আকীকা করা যাবে)।’ [আবূ দাউদ : ২৮৩৬; মুসনাদ আহমদ : ২৭৪০৯।]
উম্মে কুরয আল-কা‘বিয়া রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকীকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, উত্তরে তিনি বলেন,
«عَنِ الْغُلاَمِ شَاتَانِ وَعَنِ الْجَارِيَةِ وَاحِدَةٌ وَلاَ يَضُرُّكُمْ ذُكْرَانًا كُنَّ أَمْ إِنَاثًا».
‘ছেলে সন্তানের পক্ষে সমবয়সী দু’টি ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষে একটি ছাগল (দিয়ে আকীকা দেয়া যাবে) আর ওই ছাগলগুলো পাঠা হোক বা পাঠ তাতে তোমাদের কোনো অসুবিধা নাই।’ [তিরমিযী : ১৫৯৯; মুসনাদ আহমদ : ২৭৩৭৩।]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَقَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْحَسَنِ ، وَالْحُسَيْنِ بِكَبْشَيْنِ كَبْشَيْنِ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার জন্য দু’টি দু’টি করে ভেড়া দিয়ে আকীকা করেন।’ [নাসায়ী : ১২১৯।]
আকিকার দোয়া:
اللهم هذه عقيقة فلان……… دمها بدمه ولحمها بلحمه وعظمها بعظمه وجلدها بجلده وشعرها بشعره ….
اَللَّهُمَّ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْض حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا اول مِنَ الْمُسْلِمِينَ – بِسْمِ اللهِ اَللهُ اكبر –
বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা হাজিহি আকিকাতু ফুলানি ( এই স্থলে ছেলে বা কন্যার নাম উল্লেখ করবেন ) দামুহা বিদামিহি, ওয়া লাহমুহা বিলাহমিহি ,ওয়া আজমুহা বি আজমিহি ,ওয়া জিলদুহা বিজিলদিহি ,ওয়া শায়রুহা বি শায়রিহি ,
ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফা ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন । ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন । লা শারিকালাহু ওয়া বি জালিকা উমিরতু ওয়া আনা আউয়ালু মিনাল মুসলিমিন । বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ।
উল্লেখিত দোয়াটি না পারলেও সমস্যা নেই । কার জন্য আকিকা করা হচ্ছে তার খেয়াল অন্তরে রেখে এ দোয়াটি পড়ে জবাই করলেও হবে ।
بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر –
বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার ।
আকিকার সময় :
শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিনে আকিকা করা উত্তম। হজরত রাসূল সা: নিজে সপ্তম দিনে আকিকা করেছেন। কোনো কারণে ৭ম দিনে আকিকা করা সম্ভব না হয়, তাহলে১৪ দিনে আকিকা করতে হয়। তাও সম্ভব না হয় তাহলে ২১ দিনে আকিকা করতে হয়। তাও সম্ভব না হলে, অন্য যেকোনো দিনে আকিকা আদায় করে নিতে হবে। হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক শিশু তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধকস্বরূপ। কাজেই সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে জবাই করবে এবং তার মাথা মুণ্ডন করে নাম রাখবে ।
আকিকার পশুর সংখ্যা :
নবজাতক শিশুর জন্য আকিকা গুরুত্বপূর্ণ।আকিকা উট, গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগল দিয়ে করতে হবে। আকিকার পশু সুস্থ, সবল ও ত্রুটিমুক্ত হতে হয়। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) তাদেরকে ছেলে সন্তানের জন্য দুটি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করার জন্য নির্দেশ করেছেন।
আকিকার গোশত বিতরণ :
আকিকার গোশত ইচ্ছে হলে রান্না করে আত্মীয়-স্বজন ও গরিব-মিসকিনকে খাওয়ানো যাবে। তবে কুরবানীর মতো আকিকার পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য, এক অংশ গরিব-মিসকিনদের জন্য সাদকা করে দিয়ে বাকি এক অংশ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া সুন্নত। আকিকার গোশত সচ্ছল আত্মীয় স্বজনকেও দেয়া যায়।
আকিকার পশুর গোশত খেতে কারো কোনো বাধা নেই। আকিকার পশুর গোশত নিজেরা খেতে পারবে এবং অন্যদেরও খাওয়ানো যাবে।
আকিকার পশুর চামড়া :
কুরবানীর মতো আকিকার পশুর চামড়া বাজারে বিক্রি করে, বিক্রিয়কৃত টাকা গরিব-মিসকিনের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।
আরো পড়ুন: এলোভেরা জেল ত্বকে ব্যবহারের নিয়ম ও কাজ সমূহ
পরিশেষে :
বলা যায় যে ,নবজাতক শিশুর বাবা-মায়ের দানশীলতা প্রকাশ পায়আকিকার মাধ্যমে । গরিব, ইয়াতিম ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গোশত বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে আত্মীয়তার হক আদায় হয়। একটি নতুন প্রাণের আগমনকে কেন্দ্র করে আকিকা দেয়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা নবজাতকে বালা-মুসিবতথেকে রক্ষা করেন ।