আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে বর্তমানে আমাদের দেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বিল পরিশোধ, অনলাইন শপিং, বিদেশ ভ্রমণ কিংবা জরুরি খরচ, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ক্রেডিট কার্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে দেশের লাখো নাগরিকের জন্য ব্যাংকিং এর এই আর্থিক সেবা গ্রহণ এখন আরও সহজ এবং সহজলভ্য হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।তবে চাইলেই কি যে কেউ ক্রেডিট কার্ড নিতে পারেন? না, এর জন্য রয়েছে কিছু শর্ত ও যোগ্যতা। 

ক্রেডিট কার্ড:

ক্রেডিট কার্ড হলো একটি ছোট প্লাস্টিকের কার্ড যাতে শনাক্তকরণের একটি মাধ্যম থাকে, যেমন একটি স্বাক্ষর বা ছবি, যা এটিতে নামযুক্ত ব্যক্তিকে একটি অ্যাকাউন্টে পণ্য বা পরিষেবা চার্জ করার অনুমতি দেয়, যার জন্য কার্ডধারককে পর্যায়ক্রমে বিল করা যায় ।

ব্যাংকগুলো প্রধানত ভিসা, মাস্টারকার্ড, ডিসকভার এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস- এই চার মূল ধরনের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে থাকে।ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত প্লাস্টিকের পাতলা আয়তক্ষেত্রাকার কার্ড ই হচ্ছে  এক কথায় ক্রেডিট কার্ড। এই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকদের যে কোনো পণ্য ক্রয়ের জন্য ও পরিষেবা অর্থ ঋণের সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রযোজ্য সুদসহ এই ঋণকৃত অর্থটি কার্ড ধারককে ফেরত দিতে হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।

১৯২০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়।  যখন থেকে তেল কোম্পানি এবং হোটেল চেইনগুলির মতো পৃথক সংস্থাগুলি কোম্পানির আউটলেট গুলিতে কেনাকাটার জন্য গ্রাহকদের কাছে এই কার্ড ইস্যু করা শুরু করেছিল।  এই সিস্টেমের অধীনে, ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি তার কার্ডধারীদের একটি বার্ষিক ফি নেয় এবং তাদের পর্যায়ক্রমিক ভিত্তিতে-সাধারণত মাসিক বিল দেয়। সারা বিশ্বে সহযোগিতাকারী ব্যবসায়ীরা ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারীকে মোট বিলিংয়ের 4-7 শতাংশের মধ্যে একটি পরিষেবা চার্জ প্রদান করে থাকে।

ক্রেডিট কার্ড-এর সুবিধাগুলো:

ক্রেডিট কার্ড হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি বিশেষ সুবিধা। যাতে দ্রুত লেনদেন করা যায়।দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন পণ্য বা পরিষেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড-এর আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধাগুলোর কারণে প্রতিদিনই এই কার্ডের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে।

  • ব্যয়বহুল পণ্য বা পরিষেবা তাৎক্ষণিক ভাবে কেনা যায়।
  • অনলাইনে কোনো ঝামেলা ছাড়াই কেনাকাটা করা সম্ভব হয় ।
  • ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটায় রিওয়ার্ড পয়েন্ট-এর সুযোগ থাকে, যেটি বাড়ার ফলে ক্রেডিট কার্ড থেকে খরচের মাধ্যমেই আয়সহ বিভিন্ন মূল্যছাড় এমনকি ফ্রিতে পণ্য বা পরিষেবা ক্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে ।
  • অধিক পরিমাণে কেনাকাটার পাশাপাশি সময়মত ক্রেডিট কার্ড-এর বিল প্রদান করলে ক্রেডিট কার্ডধারীর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে ঋণ লাভের যোগ্যতার সূচক সংখ্যা বা সিআইবি রেকর্ড বাড়ে।
  • ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ড-এর চার্জ বেশি বা অন্য কোনো ক্রেডিট কার্ড-এর সুযোগ-সুবিধা মনে হলে সহজেই বর্তমান কার্ড থেকে সেই কার্ড-এ স্থানান্তরিত করতে পারে ।
  • পেমেন্ট গেটওয়ে বা মার্চেন্ট সেবায় কোনো অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়লে ক্রেডিট কার্ড-এ সহজেই টাকা ফেরতের জন্য আবেদন করা যায়, যার জন্য কাগজের চেক অপেক্ষা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার অধিক নিরাপদ হয় ।
  • ক্রেডিট কার্ড চুরি হলে বা হারিয়ে গেলে নিকটবর্তী সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে দ্রুত অর্থ ফেরতসহ একদম নতুন কার্ড পাওয়া যায়।

ক্রেডিট কার্ড কারা পাবেন:

যারা যারা ক্রেডিট কার্ড কারা পাবেন-

(১) ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য সর্ব প্রথম শর্ত হলো আয় থাকতে হবে অথবা ব্যাংকে জমা রাখা অর্থ থাকতে হবে। আপনার যদি আয় থাকে বা জমা করা টাকা থাকে, তাহলে আপনাকে যেকোনো ব্যাংক আপনাকে কার্ড দিতে পারে।

(২)চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে যাদের মাসিক বেতন যদি ৩০ হাজার টাকা,তারা ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন ।

(৩)ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে বছরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে লেনদেন থাকলে তারা ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্তা রাখে ।

(৪)নির্ভরশীল শিক্ষার্থীরা যোগ্য পরিবারের সদস্য হলে অনেক ব্যাংকে অ্যাড-অন কার্ড নেওয়ার সুযোগপেয়ে থাকে।

কীভাবে নেবেন:

বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকে অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের আবেদন গ্রহণ করে থাকে । আপনি অনলাইনে আবেদন করলে ব্যাংকের বিক্রয়কর্মীরা আপনার ঠিকানায় গিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্র সংগ্রহ করে থাকে । যাচাই-বাছাই শেষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যায় ক্রেডিট কার্ড ও পিন নম্বর।কার্ড পেতে ব্যাংকে আলাদা হিসাব খুলতে হয় না, তবে কিছু কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেটি প্রয়োজন হতে পারে।

যেসব কাগজপত্র লাগবে:

ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য আপনাকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। সেগুলো হলো:

  • জাতীয় পরিচয়পত্র। (এনআইডি)
  • দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি। 
  • বর্তমান ঠিকানার প্রমাণ।  বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিল)
  • ব্যাংকের ছয় মাসের স্টেটমেন্ট। (যদি থাকে)
  • নমিনির এনআইডি  ও ছবি। 

রেফারেন্স (সাধারণত ওই ব্যাংকের একাউন্ট ধরি কোনো গ্রাহকের নাম)। আবার অনেক ব্যাংকে আলাদা সেভিংস হিসাব না খুলেও কার্ড নেওয়া যায়।

কীভাবে আবেদন করবেন:

আপনি অধিকাংশ ব্যাংকেই এখন অনলাইনে সরাসরি আবেদন করতে পারবেন । আবেদন করার পর ব্যাংকের প্রতিনিধি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য সরাসরি আপনার ঠিকানায় আসবে।

ব্যাংক আবেদন যাচাই করে দেখবে আপনি ক্রেডিট স্কোর, আয় ও ব্যয়ের প্রমাণ এবং লেনদেন সক্ষমতা দেখাতে পারছেন কি না। যাচাই-বাছাই শেষে ব্যাংক আপনার জন্য একটি ক্রেডিট লিমিট নির্ধারণ করবে এবং কার্ড ইস্যু করবে।

খরচের নিয়ম:

ক্রেডিট কার্ডের মূল বিষয় হলো—আপনি এখন খরচ করছেন, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংককে সেই অর্থ ফেরত দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করলে আপনাকে উচ্চ হারে সুদ দিতে হতে পারে ।

কার্ড পাওয়ার পর আপনাকে পিন নম্বর সেট করতে হবে, যা ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে । প্রতি মাসে কত খরচ পর্যন্ত আপনি করতে পারবেন এবং কোন তারিখের মধ্যে বিনাসুদে বিল পরিশোধ করতে হবে—সেই তথ্যগুলো জেনে রাখা আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো বিল পরিশোধ করলে আপনাকে সুদ দিতে হবে না ।

প্রতিটি ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বার্ষিক মাশুল কেটে থাকে । তবে অনেক ব্যাংক নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন হলে এই মাশুল মওকুফ করে দেয়। তাই আগে থেকেই হিসাব করে রাখা ভালো যে বছরে আপনি কতটি লেনদেন করবেন।

বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড:

ক্রেডিট কার্ড প্রথম বাংলাদেশে চালু হয় ১৯৯৭ সালে। তৎকালীন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক (বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) এই সেবা চালু করে। একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভনিক বাংলাদেশ (বর্তমানে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স) ও ন্যাশনাল ব্যাংকও এ সেবা চালু করে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০টি ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিয়ে থাকে । অধিকাংশ ব্যাংকে ভিসা ও মাস্টারকার্ড ব্র্যান্ডের কার্ড রয়েছে । এর বাইরে কিছু ব্যাংক তাদের কার্ড সেবায় ভিন্নতাও  এনেছে। উদাহরণস্বরূপ, সিটি ব্যাংক আমেরিকান এক্সপ্রেস (এমেক্স) কার্ড দিচ্ছে , প্রাইম ব্যাংক জেবিসি দিচ্ছে , ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ডিনার্স ক্লাব, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নেক্সাস পে দিচ্ছে এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক দিচ্ছে ইউনিয়ন পে ইন্টারন্যাশনাল কার্ড।

পরিশেষে :

বলা যায় যে , আমাদের জীবন যাত্রা অনেক সহজ করে তুলেছে ক্রেডিট কার্ড। তবে এটি সঠিক ভাবে ব্যাবহার না করলে অনেক সমস্যায় পড়তে হবে ।  অনেকেই অগ্রিম নগদ দেওয়ার বদলে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। এটা মারাত্মক একটি ভুল। শুধু প্রয়োজনীয়তাই নয়; এর পাশাপাশি ভাবতে হবে জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করে ক্রেডিট কার্ড পরিচালনার যথেষ্ট সক্ষমতা আছে কি না। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটার পথ সুগম হওয়াতে অহেতুক খরচবাড়ার প্রবণতা বাড়ে। এটি সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার হলেও এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে চরম আর্থিক অস্থিতিশীলতা। তাই একটি নির্ভরযোগ্য আর্থিক সচ্ছলতার পরেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার খরচগুলোতে ভারসাম্যতা বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়।

Write A Comment