আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। জমি আছে কিন্ত কোন ঝামেলয় পড়েন নাই এমন লোক বাংলাদেশে খুজে পাওয়া বড় মুশকিল। জমি সংক্রান্ত সমস্যাকে ঘিরে অনেক দালাল চক্র সৃষ্টি হয়েছে। আর দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন।এর প্রধান কারণ জমি সংক্রান্ত জ্ঞান অনেকেরই জানা নাই । এছাড়াও তারা কোন দিন জমির খাজনা পরিশোধ করে নাই।

জমির খাজনা পরিশোধ করলে সেই জমিতে কোন প্রকার জটিলতা সৃষ্টি হয় না। যদিও হয় তাহলে খাজনার রশিদ আপনাকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে ।মূলত আইনি সহায়তা পেতে জমির খাজনা পরিশোধ করা অত্যান্ত জরুরী।

খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর  :

জমির মালিকানা সংক্রান্ত ও ভোগ দখলের সুবিধা পাওয়ার জন্য সরকারকে প্রতিবছর প্রতি শতাংশ জমির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয়। মূলত একেই ভূমি উন্নয়ন কর বা জমির খাজনা বলা হয়ে থাকে। বহু আগে থেকেই জমিদারগণ জমির উপর খাজনা আদায় করতেন। তবে বর্তমানে সরকারিভাবে দেশের ভূমি বিষয়ক উন্নয়নের জন্য সে খাজনা বা‌ রাজস্ব আদায় করা হয়। ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করলে একটি খাজনা রশিদ বা দাখিলা প্রদান করা হয়ে থাকে । সেটি জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় ।

 ১৯৭৬ সালের ভূমি উন্নয়ন কর বিধি মালার ৭ বিধি অনুসারে, নাগরিকের বেশকিছু খাজনা সংক্রান্ত অধিকার রয়েছে। যেমন :  খাজনা প্রদান করে দাখিলার মাধ্যমে জমির মালিকানা প্রমাণের অধিকার, খাজনা প্রদান করে দাখিলা গ্রহণের অধিকার,যদি কোনো ব্যক্তি খাজনাসংক্রান্ত ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশে অসন্তুষ্ট হন সে ক্ষেত্রে আপিলের অধিকার ইত্যাদি রয়েছে । ১৯৭৬ সালের ভূমি উন্নয়ন কর বিধিমালা অনুসারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার বিনা খাজনায় জমির ভোগদখলের অধিকার রয়েছে। 

খাজনা প্রদানের সুবিধা:

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই  প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে থাকেন  এবং আইনি বিষয় সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ থাকার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে তারা  অবহেলা করেন। এসবের মধ্যে খাজনা প্রদান একটি। কিন্তু তারা জানেন না যে খাজনা প্রদান করলে বিভিন্ন সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবেন। 

  • ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের ফলে যে দাখিলা পাওয়া যায় ওই দাখিলা মালিকানা প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে গণ্য গণ্য করা হয়ে থাকে। 
  • ভূমি উন্নয়ন কর নিয়মিত প্রদান করলে রেকর্ড হালনাগাদ হয় ।
  • নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করলে দুষ্ট লোকেরা ভুয়া রেকর্ডের সুযোগ নিতে পারে না। 
  • ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ থাকলে  একজন আরেকজনের জমি গোপনে নামজারি বা রেকর্ড করিয়ে নিতে পারে না। 
  • জমির মালিক নিজের জমির খোঁজখবর রাখার কারণে ভুয়া নামজারি বা মিউটেশনের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে  । 
  • ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পরিশোধ থাকলে জমি নিলাম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

খাজনার বকেয়া থাকলে জরিমানা: 

খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর বার্ষিক ভিত্তিতে দিতে হয়। প্রতি বছরের ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা যথাসময়ে নিয়মিত পরিশোধ করলে কোনো সুদ দিতে হয় না। যদিও খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর অন্য যে কোনো ধরনের করের তুলনায় কম, তবুও খাজনা বকেয়া পড়তে থাকলে সুদের হার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন করের ওপর ধার্যকৃত সুদের হার ৬.২৫ শতাংশ। যদি ভূমি উন্নয়ন কর এক বছরের বকেয়া হয় সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাংলা সনের ৩০ চৈত্রের পরই ওই কর বকেয়া বলে গণ্য হবে এবং মূল পাওনাকৃত করের সঙ্গে ৬.২৫ হারে সুদ যোগ হবে এবং যত বছরের কর বাকি থাকবে তত গুণ সুদ বেশি হবে এবং মূল করের সঙ্গে যুক্ত হবে।

জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম:

জমির খাজনা ২ উপায়ে দেওয়া যেতে পারে-

( ১) উপজেলা ভূমি অফিসে এবং 

(২) অনলাইনে খাজনা পরিশোধ করে।

( ১) উপজেলা ভূমি অফিসে খাজনা দেয়ার নিয়ম :

জমির খাজনা দিতে গিয়ে অনেকেই  ঝামেলায় পড়ে থাকেন । কারন অনেকেই জানেন না তাদের ভূমি অফিস কোনটি নতুবা কোথায় গিয়ে জমা দিতে হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নির্ধারিত ভূমি অফিস রয়েছে। এই ভূমি অফিস খাজনা গ্রহন এবং রশিদ প্রদান করে থাকেন। আপনার জমির কাগজপত্র গুলো ভূমি অফিস এ নিয়ে গেলে তার আগে দেখবে কোন জমির খাজনা দিতে চান তার দাগ নম্বর ও খতিয়ান নম্বর দেখে সেই জমির বকেয়া কর/খাজনা দেখে আপনার থেকে সেই ফি টি গ্রহন করবে এবং আপনাকে প্রমাণ স্বরুপ একটি রশিদ প্রদান করবে।

(২) অনলাইনে খাজনা পরিশোধ করার নিয়ম:

ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা অত্যধিক হয়ে গেছে আর অফিসগুলোতে দালালদের আনাগোনা থাকায় সাধারণ মানুষ হয়রানির স্বীকার হয়ে থাকে। এই দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় অনলাইনে জমির খাজনা পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করেছে। ফলে যে কেউ ঘরে বসে তার জমির খাজনা অনলাইনে পরিশোধ করতে পারবেন। এতে দুর্নীতি মুক্ত ভূমি সেবা নিশ্চিত হবে। 

১ধাপ- ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রেজিস্টার:

ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের https://ldtax.gov.bd এই লিংকে প্রবেশ করুন। এবার, নাগরিক কর্নার অপশনে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য, মোবাইল নাম্বার, জন্মতারিখ ও পাসওয়ার্ড দিয়ে রেজিস্টার করতে হবে । তারপর  পুনরায় তথ্য দিয়ে লগইন করুন।

 ২ধাপ- প্রোফাইল সেটিং:

লগইন করার পর একটি ড্যাশবোর্ড ওপেন হবে।  অনলাইনে কর পরিশোধের জন্য প্রথমেই, প্রোফাইল ১০০% নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য, প্রোফাইল অপশনে ক্লিক করে সম্পাদন বাটনে ক্লিক করুন। এখানে আপনার ইমেইল ও বর্তমান ঠিকানার অপশনটি অসম্পূর্ণ থাকবে। ধাপে ধাপে তথ্য দিয়ে আপনার প্রোফাইলটি ১০০% সম্পন্ন করে নিতে হবে ।

৩ ধাপ-খতিয়ান আপলোড করুন: 

অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ অনুযায়ী খাজনা পরিশোধের পূর্বে আপনার জমির নতুন খতিয়ান যুক্ত করতে হবে। সেজন্য, আপনার একাউন্টের ড্যাশবোর্ড থেকে খতিয়ান অপশনে ক্লিক করুন। এবার একটি বিস্তারিত ফরম আপনি দেখতে পাবেন।

  • বিভাগ নির্বাচন করুন (ডান পাশের ড্রপডাউন মেনু থেকে)
  • জেলা নির্বাচন করুন
  • উপজেলা বা সার্কেল নির্বাচন করুন
  • মৌজা সিলেক্ট করুন
  • খতিয়ান নং লিখুন
  • আপনার জমির হোল্ডিং নম্বর লিখুন এবার খতিয়ান আপলোডের জন্য সংযুক্তি হিসেবে খতিয়ানের স্ক্যান কপি বা পূর্বের কর পরিশোধের দাখিলার স্ক্যান কপি আপলোড করতে হবে। সেজন্য Choose File অপশনে ক্লিক করে মোবাইল বা কম্পিউটারে পূর্বে সংগ্রহ করে রাখা ফাইল আপলোড করেন।
  • মালিকানার ধরন নির্বাচন করতে হবে। নিজের মালিক না হয়ে উত্তরাধিকার হলে উত্তরাধিকার সনদ বা ওয়ারিশ সনদপত্রের স্ক্যান কপি আপলোডকরতে হবে ।
  • সর্বশেষ ‘সংরক্ষণ করুন’ বাটনটিতে  ক্লিক করুন।

অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ অনুযায়ী এই পেইজে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করার পর খতিয়ান আপলোড হতে ২৪ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।এরপর সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস প্রদানকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে হোল্ডিং এন্ট্রি সম্পন্ন করবে।

৪ধাপ- হোল্ডিং ও ভূমি উন্নয়ন করের তথ্য:

খতিয়ান আপলোড সম্পন্ন হলে পুনরায় ভূমি উন্নয়ন কর ওয়েবসাইটে নাগরিক লগইন করে ড্যাশবোর্ডে চলে যেতে হবে । তারপর ড্যাশবোর্ড থেকে হোল্ডিং অপশনে ক্লিক করতে হবে । আপনার খতিয়ান টি সঠিকভাবে আপলোড হওয়ার পর হোল্ডিং নম্বর অনুযায়ী জমির পরিমাণ ও নিম্নোক্ত তথ্যগুলো দেখতে পাবেন-

  • জমির অবস্থানের ঠিকানা।
  • খতিয়ান ও দাগ নাম্বারের তথ্য।
  • জমির পরিমান।
  • জমির মালিকের নাম.
  • জমির ধরন (নালা, ভিটা, নাল, বোরো ইত্যাদি).
  • ভূমিভেদে খাজনার পরিমাণ।
  • সর্বশেষ কত সালে কর পরিশোধ করা হয়েছিল।
  • বকেয়া দাবি কত টাকা।
  • মোট দাবি কত টাকা।
  • হাল দাবি কত টাকা।
  • এবং বর্তমানে সর্বমোট কত টাকা খাজনা পরিশোধ করতে হবে ইত্যাদি বিস্তারিত সব তথ্য দেখতে পাবেন।

৫ধাপ- অনলাইন পেমেন্ট অপশন সিলেক্ট:

অনলাইন পেমেন্ট অপশনে ক্লিক করার পর পরবর্তী পেইজে জমির মালিকের নাম ও কত টাকা পেমেন্ট করতে হবে তা দেখানো হবে। এছাড়াও নিচে বিভিন্ন পেমেন্ট অপশন দেখানো হবে। বাংলাদেশের সর্বত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে এমন পেমেন্ট অপশনগুলো ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছে।অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ অনুযায়ী এই পেমেন্ট অপশনগুলো থেকে আপনার সুবিধা অনুযায়ী বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, ekPay, DBBL (ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড এর অনলাইন ব্যাংকিং) ইত্যাদি থেকে একটি অপশন সিলেক্ট করে ই-পেমেন্ট করুন বাটনে ক্লিক করতে হবে ।

৬ ধাপ-ই-পেমেন্ট করুন:

নির্দিষ্ট একটি পেমেন্ট অপশন (যেমন- বিকাশ) সিলেক্ট করলে তার মাধ্যমে পেমেন্ট করার জন্য একটি নতুন পেইজ ওপেন হবে। বিকাশের মাধ্যমে পেমেন্ট পরিশোধ করার জন্য প্রথমেই আপনার বিকাশ নাম্বারটি লিখে কনফার্ম বাটনে ক্লিক করতে হবে ।তারপর আপনার দেওয়া বিকাশ নাম্বারে একটি ভেরিফিকেশন কোড আসবে । ভেরিফিকেশন কোডটি পরবর্তী পেজে লিখে কনফার্ম বাটনে ক্লিক করলেই আপনার অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ সম্পন্ন হবে।

৭ ধাপ- খাজনা রশিদ ডাউনলোড:

জমি খাজনা পরিশোধ করার ভূমি উন্নয়ন কর ওয়েবসাইট থেকে একটি খাজনা রশিদ বা দাখিলা প্রদান করা হয়। মূলত উক্ত রশিদ টিই জমির কর পরিশোধের কপি। এই কপিটি সংগ্রহ করতে ভূমি উন্নয়ন কর ওয়েবসাইটে আপনার অ্যাকাউন্টের ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ করে মেন্যু থেকে দাখিলা অপশনে ক্লিক করতে হবে ।অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ অনুযায়ী দাখিলা আপলোড হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। আপলোড সম্পন্ন হলে তার পিডিএফ কপি ডাউনলোড করতে পারবেন অথবা প্রিন্ট অপশন এ ক্লিক করে কম্পিউটারের সংযুক্ত প্রিন্টার দিয়ে প্রিন্ট করে সংরক্ষণ করতে পারবেন।

জমির খাজনা কত টাকা:

ভূমি মন্ত্রণালয়ের ঘোষনা অনুযায়ী, ৫-১০ একর পর্যন্ত জমির ক্ষেত্রে প্রথম ৫ একরের জন্য ৫১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতক ৩৬ পয়সা। ১০-১৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১০ একরের জন্য ২৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতক ৬০ পয়সা। ১৫-২৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১৫ একরের জন্য ৫৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতক ৬০ পয়সা করে অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম ২০২৩ অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে।

আরো পড়ুন :অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কেনার নিয়ম নতুন ই-টিকিটিং সিস্টেম।

পরিশেষে :

বলা যাই যে ,প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকেরা জমির খাজনা দিতেন।১৯৭৬ সালে ভূমি (উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ )জারির মাধ্যমে খাজনা শব্দটির পরিবর্তে ‘ভূমি উন্নয়ন কর’ আনুষ্ঠানিক পরিভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । বাংলা সনের ভিত্তিতে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়। আশা  করি উপরের লেখাটি মনযোগ সহকরে পড়লে আপনি ঘরে বসেই আপনার জমির খাজনা পরিশোধ করতে পারবেন।প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকেরা জমির খাজনা দিতেন।

 

Write A Comment