আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ হতে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্তের ফরজ নামাজের পর কোন কথা বা সুন্নত নামাজ না পড়ে একবার করে তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব।জামাতে নামাজ পড়া হোক বা একাকি, পুরুষ বা নারী, মুকীম বা মুসাফির সকলের উপর এটি ওয়াজিব। তাকবির জোর আওয়াজ করে বলা ওয়াজিব। তবে নারীরা আস্তে বলবে। নামাজের সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই তাকবির বলতে হবে। ইমাম যদি বলতে ভুলে যানও তবু মুক্তাদিরা সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে বলবেন।
তাকবিরে তাশরিক :
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর নামাজের পর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত সময়কে তাশরিকের দিন বলা হয়ে থাকে এবং এই সময়ে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর অন্তত একবার ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ এই তাকবির পড়া ওয়াজিব। এটিকে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়। (হেদায়া : ১/২৭৫)এ তাকবিরে মুসল্লিরা মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়োত্ব ও একক সত্তার কথা বলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে থাকেন ।
মহান আল্লাহর প্রিয় বাক্যগুলোর একটি হলো- আল্লাহু আকবার। তাই তাকে খুশি করতে হলে শুধু নামাজের সময় নয় প্রায় সারাদিনই তাকবির বেশি বেশি পড়া উচিত।
তাকবিরে তাশরিক হচ্ছে-
الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله والله أكبر، الله أكبر ولله الحمد
(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদু)
তাকবিরে তাশরিকের পটভূমি:
বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেছেন, যখন হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে জবাইয়ের উদ্দেশ্যে গলায় ছুরি রাখলেন, এদিকে আল্লাহর নির্দেশে হজরত জিবরাঈল (আ.) আসমান থেকে একটি দুম্বা নিয়ে দুনিয়ায় আগমন করলেন । কিন্তু জিবরাঈল (আ.)-এর আশঙ্কা ছিল, তিনি দুনিয়াতে পৌঁছার আগেই ইবরাহিম (আ.) জবাই পর্ব সমাপ্ত করবেন ।ফলে তিনি আসমান থেকে উঁচু আওয়াজে বলে উঠলেন – ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার।’
ইবরাহিম (আ.) আওয়াজ শুনে আসমানের দিকে নজর ফেরাতেই দেখতে পেলেন জিবরাঈল (আ.) একটি দুম্বা নিয়ে আগমন করছেন। ফলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর।’ পিতার কণ্ঠে এই কালিমা শুনতেই ইসমাঈল (আ.) উচ্চারণ করলেন : ‘আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
একজন ফেরেশতা আর দুজন প্রিয় নবীর এ বাক্যমালা আল্লাহর খুব পছন্দ হয়। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এই বাক্যমালা আইয়ামে তাশরিকে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পড়াকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। (ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/১৭৮, ইনায়া শরহুল হিদায়া : ১/৪৬৪)
তাকবিরে তাশরিকের ফজিলত:
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যেন তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৮)
বিখ্যাত সাহাবি মুফাসসির ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, এখানে ‘নির্দিষ্ট দিন বলতে ‘আইয়ামে তাশরিক’ ও ‘আল্লাহর স্মরণ’ বলতে তাকবিরে তাশরিক বোঝানো হয়েছে।(বুখারি, অধ্যায় দুই ঈদ)
এখানে নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা আইয়ামে তাশরিক উদ্দেশ্য এবং জিকির দ্বারা তাকবিরে তাশরিক উদ্দেশ্য বলা হয়েছে । (ইবনে কাসির)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, এই দিনগুলোতে তাকবিরে তাশরিকের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে নিজের জান ও সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৬৯)
তাকবিরে তাশরিক সংক্রান্ত কিছু মাসায়েল:
(১). প্রত্যেক মুসল্লির জন্য জিলহজের ৯ তারিখের ফজর হতে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজ আদায় করে সালাম ফিরানোর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব।(আদ্দুররুল মুখতার ৩/১৭৭-১৭৮)
(২). নারীরা এই তাকবিরে তাশরিকটি নিচু স্বরে আদায় করবেন। উচ্চস্বরে নয়। (রদ্দুল মুহতার ২/১৭৯; হাশিয়া তাহতাবী ১/৩৫৭; হিন্দিয়া ১/১৫২)
(৩). ইমাম তাকবির বলতে ভুলে গেলে মুক্তাদিরা ইমামের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের তাকবির বলতে হবে ।(বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২)
(৪). প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালামের পর পরই কোনো কথাবার্তা বা নামাজ পরিপন্থী কোনো কাজ করার আগেই তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২)
(৫). কোনো সময় সবাই বা কেউ কেউ তাকবির বলতে ভুলে গিয়ে মসজিদ থেকে বের না হয়ে গেলে তাকবির আদায় করে নিতে হবে। আর যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে এই ওয়াজিব ছুটে যাবে। এই ওয়াজিবের কোনো কাজা নেই এবং ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়ার কারণে ওই ব্যক্তি গুনাহগার হবে।(মাবসূত সারাখসী ২/৪৫; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫০৯-৫১১; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬০-৪৬১; রদ্দুল মুহতার ২/১৮১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২১৬)
(৬). আইয়ামে তাশরিকের কোনো নামাজ কাযা হয়ে গেলে ওই দিনগুলোর মধ্যে তার কাজা আদায় করলে তাকবির বলা ওয়াজিব। কিন্তু এই কাজা পরবর্তী অন্য সময় আদায় করলে বা আইয়ামে তাশরীকের আগের কাজা নামায ওই দিনগুলোতে আদায় করলে তাকবির বলা ওয়াজিব নয়।(বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; আলমুহীতুল বুরহানী ২/৫১১-৫১৩)
(৭). কোনো ব্যক্তি নামাজে মাসবুক হলে ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর দাঁড়িয়ে নিজের নামাজ আদায় করার পর তাকবিরে তাশরিক বলতে হবে।(মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৪/২৩৯-২৪০; বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/১৮০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২)
আরো পড়ুন :পঞ্জিকা দেখার নিয়ম এবং দৈনন্দিন জীবনে পঞ্জিকার ব্যবহার।
পরিশেষে :
বলা যায় যে ,এক জন মুমিনের জন্য তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, এই দিনগুলোতে তাকবিরে তাশরিকের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী করিম (স.) বলেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (সহিহ বুখারি: ৯৬৯)