আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। তেলাপোকা বিরক্তিকর একটি পতঙ্গ হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিকরও ।এরা সব সময় ময়লা-আবর্জনায় বসবাস করে এবং ক্ষতিকর রোগজীবাণু বহন করে । ঘরের লাইট বন্ধ হলেই বেড়ে যায় তেলাপোকার আনাগোনা। খাবারের খোঁজে ঘরে থাকা খাবার-দাবারসহ জিনিষ পত্রের ওপর হেঁটে বেড়ায়। এদের উপদ্রবে অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে পরে । বাজারে তেলাপোকা নিধনের জন্য নানা রকম স্প্রে ও পাউডার জাতীয় রাসায়নিক স্প্রে বা ওষুধ পাওয়া যায়। তবে এগুলো ক্ষতিকর হয় এবং নানা রকম অসুখেরও কারণ হয় ।
তেলাপোকা বা আরশোলা ব্লাটোডা পর্বের পোকা বলা হয়ে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক এই পোকা যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।গবেষকরা বলছেন, ৪৬০০ প্রজাতির মধ্যে মানুষের বাসস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত তেলাপোকার প্রজাতি রয়েছে প্রায় ৩০টি। এই ৩০টি প্রজাতির মধ্যে ৪টি প্রজাতিকে বেশ ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
তেলাপোকা দূর করার উপায়:
গরমের এই সময়টায় ঘরোয়া উপায়ে তেলাপোকার উপদ্রব কমাতে পারেন অতি সহজেই। এর জন্য রান্নাঘরেরই কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ব্যবহার করে তেলাপোকা নিধনের কিছু ঘরোয়া উপায় উঠে এসেছে। চলুন জেনে নেয়া যাক ঘরোয়া উপায় গুলো –
বাড়িঘর পরিষ্কার এবং শুকনো রাখা :
তেলাপোকা অন্যান্য পোকামাকড় খাবার এবং আর্দ্রতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সুতরাং যদি রান্নাঘর বা বাড়িঘর পরিষ্কার এবং শুষ্ক না হয়, তাহলে তা তেলাপোকার আবাসস্থল হয়ে উঠে । তাই রান্নাঘর বা বাড়িঘর নিয়মিত পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। কাউন্টারটপ, স্টোভটপ এবং অন্যান্য স্থান প্রতিদিন মুছে ফেলুন যাতে কোনো খাবারের টুকরো এবং ময়লা আবর্জনা থেকে না যায়। পরিষ্কার করা ছাড়াও সমস্ত স্যাঁতসেঁতে জায়গা শুকিয়ে নিন। সিঙ্ক এবং পাইপের যেকোনো ফুটো ঠিক করুন। সিঙ্ক এবং কাউন্টারটপের চারপাশের জায়গাটি শুকনো রাখার চেষ্টা করুন।
খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা :
আপনার রান্নাঘরে বা বাড়িঘরে তেলাপোকার প্রবেশ বন্ধ করার জন্য খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, তেলাপোকা সহজেই খাবার শনাক্ত করতে পারে এবং অসংরক্ষিত খাবারে প্রবেশ করে থাকে। তাই শস্য এবং ময়দার মতো শুকনো পণ্যের জন্য এয়ার-টাইট পাত্র ব্যবহার করা উচিত। ফল, শাক-সবজি এবং পচনশীল জিনিস কাউন্টারটপে রাখবেন না, সেগুলো ফ্রিজে রাখুন। ময়লার ঝুড়ি হলো আরেকটি জায়গা যা তেলাপোকাকে আকর্ষণ করতে পারে তাই প্রতিদিন আবর্জনা ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করুন।
এন্ট্রি পয়েন্ট সীলমোহর:
আপনার রান্নাঘরে বা বাড়িঘরে কোনো ছোট খোলা জায়গা বা গর্ত থাকলে তেলাপোকা সেখান থেকেই চলে আসতে পারে। তেলাপোকা দূরে রাখার একটি সহজ উপায় হলো প্রবেশের পয়েন্টগুলো সিল করা। দেয়াল, মেঝে এবং ক্যাবিনেটের চারপাশে ফাটল বা ফাঁকা আছে কি না তা খুঁজে বের করে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক ব্যবহার করুন এবং তারপরে এই খোলা জায়গাগুলো বন্ধ করে রাখুন।
রান্নাঘর বা বাড়িঘরে গুছিয়ে রাখুন:
আপনার রান্নাঘর বা বাড়িঘর যদি এলোমেলো বা অগোছানো থাকে তাহলে তেলাপোকা সেখানে লুকিয়ে থাকার জায়গা খুঁজে পেতে পারে। এর ফলে তেলাপোকার আশ্রয়স্থল খুঁজে পাওয়া এবং এই পোকাকে তাড়ানো কঠিন হয়ে যাই । তাই আপনার বাড়িঘরকে পরিষ্কার করুন এবং সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখুন। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিয়ে কেবল প্রয়োজনীয় জিনিস সংরক্ষণ করতে পারেন ।
প্রাকৃতিক প্রতিরোধক ব্যবহার করুন:
কীটপতঙ্গ নিরোধকের তীব্র গন্ধ থাকতে পারে যা আপনার বাড়িঘর বা রান্নাঘরে প্রয়োগ করলে দীর্ঘ সময় থেকে যেতে পারে। এই রাসায়নিক পচনশীল পদার্থের সংস্পর্শে এলে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। নিম্নে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিরোধক ব্যবহার নিয়ম দেয়া হলো –
চিনি ও বেকিং সোডা:
বেকিং সোডা তেলাপোকার বিষ হিসেবে কাজ করে থাকে। একটি পাত্রে চিনি ও বেকিং সোডা সমপরিমাণ নিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে।এর পর মিশ্রণটি ঘরের প্রতিটি কোনায় ছিটিয়ে দিন। চিনির গন্ধে তেলাপোকা আকৃষ্ট হবে। ফলে চিনি খেতে এসে বেকিং সোডা খেয়ে সব তেলাপোকা মারা যাবে।সপ্তাহে দুই দিন করে অন্তত তিন সপ্তাহ এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে তেলাপোকা নিধন হয়ে যাবে।
তেজপাতা:
তেলাপোকা তাড়ানোর সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায় হচ্ছে তেজপাতা। তেজপাতার তীব্র ও ঝাঁঝালো ঘ্রাণ তেলাপোকা সহ্য করতে পারে না। তেলাপোকার উপদ্রব বেড়ে গেলে, কিছু তেজপাতা গুঁড়া করে ঘরের কোনাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হবে । সপ্তাহে অন্তত দুই-একবার এটি করতে পারলে তেলাপোকা উধাও হয়ে যাবে।
অ্যালুমিনিয়াম ও শসা:
কিছু শসার খোসা নিতে হবে। খোসাগুলো একটি অ্যালুমিনিয়ামের ক্যানে ঢুকিয়ে যেদিক থেকে তেলাপোকা আসতে পারে, সেসব স্থানে রেখে দিন। শসার খোসা অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে, তাতে তেলাপোকা মারা যায়।
সাবানপানি:
ঘরের যেসব স্থানে তেলাপোকার উপদ্রব বেশি, সেখানে কিছু মিষ্টিজাতীয় খাবার রাখুন। খাবারের টানে আকৃষ্ট হয়ে যখন তেলাপোকা জমবে, তার ওপর সাবানপানি দিয়ে দিতে হবে। এতে তেলাপোকাগুলো মরে যাবে।
মসলার স্প্রে:
একটি বোতলে পানির সঙ্গে রসুন, পেঁয়াজের পেস্ট এবং গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে নিতে হবে।এই মিশ্রণটি ঘরের কোনায় এবং চিপা জায়গাগুলোতে স্প্রে করে দিন। এতে তেলাপোকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
বোরিক পাউডার:
বোরিক পাউডার এক ধরনের অ্যাসিডিক উপাদানে তৈরি হয়। এই উপাদান পোকামাকড় ও পতঙ্গ নিধনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই তেলাপোকা নিধনেও এটি কার্যকর। ১ চামচ বোরিক পাউডারের সঙ্গে ২ চামচ আটা বা ময়দা মিশিয়ে মিশ্রণটি ঘরের চারপাশে ছিটিয়ে দিন। আটা-ময়দার ঘ্রাণে আকৃষ্ট হয়ে তেলাপোকা আসবে এবং বোরিক পাউডার খেয়ে মারা পড়বে।
নিম:
নিমের তেল এবং নিম পাউডারেও তেলাপোকা মারা যায় । একটি স্প্রে বোতলে পানির সঙ্গে অল্প নিম তেল মিশিয়ে নেন । যেখানে তেলাপোকা আছে, সেখানে স্প্রে করুন। আর যদি নিমের গুঁড়া ব্যবহার করতে চান, তাহলে পানিতে মিশিয়ে তেলাপোকা–উপদ্রুত স্থানে রাতে ছিটিয়ে দিন, সকালে প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করুন।
পিপারমিন্ট তেল:
তেলাপোকা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে শক্তিশালী তেলগুলির একটি হলো পিপারমিন্ট তেল। পানি ও পিপারমিন্ট তেল এক সাথে মিশিয়ে নিন। তেলের মিশ্রণ বাড়ির যেখানে তেলাপোকা দেখা যায়, সেখানে স্প্রে করুন।এতে তেলাপোকা মারা যাবে।
ন্যাপথলিন:
তেলাপোকা ন্যাপথলিনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। যেখানে তেলাপোকা বেশি আসে সেখানে কয়েকটি ন্যাপথলিন গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিন। তেলাপোকা কমে যাবে ।
সাদা ভিনেগার:
গরম পানির সঙ্গে এক ভাগ সাদা ভিনেগার মিশিয়ে সিঙ্কের ড্রেনে ঢেলে দিন রাতে ঘুমানোর আগে। পাইপে থাকা তেলাপোকা দূর হবে। দ্রবণটি সিঙ্ক ও চুলার আশেপাশেও স্প্রে করে দিতে ও পারেন ।
স্যাভলন:
২৫০ মিলি পানিতে ৪ চা চামচ স্যাভলন মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে নিন। ভালো করে ঝাঁকিয়ে যেখানে তেলাপোকার আনাগোনা বেশি সেখানে স্প্রে করুন। তেলাপোকা ও পিঁপড়া দূরহয়ে যাবে । এক সপ্তাহ টানা এভাবে স্প্রে করলে আর ফিরে আসবে না তেলাপোকা।
জানা প্রয়োজন :
তেলাপোকা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ঘরবাড়ি রাখতে হবে ময়লা ও ধুলাবালিমুক্ত। এদিক-সেদিক খাবার ফেলে রাখলে কিংবা দীর্ঘক্ষণ এঁটো থালাবাসন ফেলে রাখলে তেলাপোকার উপদ্রব বাড়ে।
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তেলাপোকার আনাগোনা বেশি । তেলাপোকা ৭ দিনের বেশি পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই ঘরদোর শুকনা রাখলে মুক্তি মিলবে তেলাপোকার যন্ত্রণা থেকে। ঘরে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
ঘরের মেঝে পরিষ্কার করার সময় কড়া সুগন্ধিযুক্ত পরিষ্কারক ব্যবহার করুন। এটি তেলাপোকার আনাগোনা কমাতে সাহায্য করে থাকে।
আরো পড়ুন :রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় ও খাবার সমূহ।
পরিশেষে :
বলা যায় যে ,অনেকেই বিভিন্ন উপায়ে তেলাপোকা তাড়ানোর চেষ্টা করেন। কীটনাশক দিয়েও অনেক সময় দূর করা যায় না তেলাপোকা। তেলাপোকা থেকে মুক্তি পেতে ঘরোয়া উপায় গুলো শ্রেয়। আশা করছি আমাদের এই আর্টিকেলটি আপনাকে তেলাপোকার উপদ্রব থেকে রক্ষা করবে।