আসসালামু আলাইকুম আশা করি ভালো আছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও সবধর্মের মানুষ কমবেশি পঞ্জিকা ব্যবহার করে থাকে । আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণে পঞ্জিকার মধ্যে বিভিন্ন সংস্করণ দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশের পঞ্জিকা ও কলকাতার পঞ্জিকা এক হয় না । তথ্যগত দিক থেকে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের প্রতিদিনের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত যে সময় হয় কলকাতায় সঙ্গে সময়ের ব্যবধানের কারণে তা এক নয়। এছাড়া অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের কারণে একস্থানের সঙ্গে অন্যস্থানের গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থানও আলাদা হয়ে থাকে।
পঞ্জিকায় বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি সালের দিন, মাস এবং বছরের প্রতিদিনের হিসাব লেখা থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন রাশিতে প্রতিদিনের গ্রহ নক্ষত্রের ডিগ্রিগত অবস্থান ও লেখা থাকে।
পঞ্জিকা:
পঞ্চাঙ্গ শব্দ থেকে পঞ্জিকা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে । বার, তিথি, নক্ষত্র, করণ ও যোগ এ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমষ্টি হচ্ছে পঞ্জিকা। প্রতিদিনের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখার জন্য পঞ্জিকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে । এছাড়া প্রতিদিনের সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, চন্দ্রোদয়- অস্ত ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কেও পঞ্জিকায় লেখা থাকে।
নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতা ও কৃত্রিম আলোর ছটায় কবে যে অমাবস্যা আর কবে পূর্ণিমা তা বুঝতে পারা কঠিন। আপনার কাছে যদি একটি পঞ্জিকা থাকে তবে বুঝতে পারবেন কোন মাসের কোন তারিখে অমাবসা আর কোন তারিখে পূর্ণিমা হবে ।
অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার রাতে যদি পাহাড় কিংবা সমুদ্রে কাটাতে চান তবে পঞ্জিকা দেখে নিতে পারেন । অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কারণে একই স্থানে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্নরূপ আপনাদের চোখে পড়বে। যারা ভ্রমণপ্রিয় তাদেরকেও আজকা কিছু কিছু পঞ্জিকায় বিভিন্ন নদীর জোয়ার ভাটার সময়ও লেখা থাকে।
দৈনন্দিন জীবনে পঞ্জিকার দেখার নিয়ম:
বিদূষী নারী খনার বচনের কথা প্রায় সবাই জানে। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘সকাল শোয় সকাল ওঠে, তার কড়ি বৈদ্য না লুটে।’
আপনি যদি সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠতে চান তবে পঞ্জিকায় কোন দিন সূর্যোদয়ের সময় কখন তা দেখে নিন । প্রতিদিনের সূর্যোদয় জানতে কমবেশি অনেকেই প্রতিদিনের পত্রিকা কিংবা পঞ্জিকা দেখে থাকেন । যারা জীবনে সফল হতে চান তারা দিনের শুরু করেন সূর্যোদয়ের আগেই।কমবেশি সব ধর্মের লোক পঞ্জিকা ব্যবহার করে থাকে । বাংলাদেশ থেকে দুই ধরনের পঞ্জিকা বের হয়। হিন্দু পঞ্জিকা ও মোহাম্মদী পঞ্জিকা।
হিন্দু পঞ্জিকা:
হিন্দু পঞ্জিকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা পার্বণের বিষয়ে বেশি তথ্য দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সব ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ দিনগুলো সম্পর্কেও বলা থাকে।
মোহাম্মদী পঞ্জিকা:
মোহাম্মদী পঞ্জিকায় চন্দ্রমাস অনুযায়ী নামাজের সময়, সূর্যের উদয়-অস্ত, দিন ও রাতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময় সম্পর্কে লেখা থাকে।
সব ধর্মের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে চন্দ্রের অবস্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মালম্বীরা চন্দ্রকলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রে পঞ্জিকার ব্যবহার:
জ্যোতিষশাস্ত্রে পঞ্জিকার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে । কোষ্ঠী/ঠিকুজি তৈরি ছাড়াও প্রতিদিনের চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে শুভাশুভ পূর্বাভাস নির্ণয় করা হয়ে থাকে। জ্যোতিষশাস্ত্র হচ্ছে সময়ের হিসাব নিকাশ করে মানুষের সম্ভাবনার কথা বলে। নিশ্চিতভাবে কোনো কিছু হবে বা ঘটবে তা বলে না। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে একসময় রাজসভায় একজন করে রাজজ্যোতিষ থাকতেন। বছরের শুরুতে তারা রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়ের পূর্বাভাস করতেন। সে অনুযায়ী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো । নির্ভুল পূর্বাভাসের কারণে রাজ জ্যোতিষেরা বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা লাভ করতেন। এবার আসুন একনজরে দেখা যাক পঞ্জিকায় যে যে বিষয়গুলো লেখা থাকে।
বার:
সপ্তাহে সাতদিন। যথাক্রমে শুক্র, শনি, রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার। সাতটি দিনের নাম এসেছে সাতটি গ্রহের নাম থেকে। (জ্যোতিষশাস্ত্র মতে চন্দ্রকেও গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। প্রতিদিনের গ্রহ ও নক্ষত্রের অবস্থান কোন রাশিতে কত ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ড অবস্থানে রয়েছে তা পঞ্জিকায় লেখা থাকে।
তিথি:
বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, একটি চান্দ্র দিনকে তিথি বলে থাকে । চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে ১২ ডিগ্রি দ্রাঘিমাকোণ বৃদ্ধির সময়কে একটি তিথির সময়কাল ধরা হয়। তিথির সূচনার সময় দিন অনুযায়ী বদল হয় এবং তিথির মোট সময়কাল ১৯ ঘণ্টা থেকে ২৬ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে থাকে। চান্দ্র মাসের প্রথম দিনকে বলা হয় প্রতিপদ। এভাবে দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী, পূর্ণিমা/ অমাবস্যা। একইভাবে পূর্ণিমার পরবর্তী প্রথমদিনকে বলা হয় কৃষ্ণা প্রতিপদ।
নক্ষত্র:
সূর্যের অয়নবৃত্তকে ২৭টি নক্ষত্র তে ভাগ করা যায়, এগুলির প্রত্যেকটি বাস্তবে কিছু তারামণ্ডল। নক্ষত্রগুলি গ্রহের পরিক্রমণকে এক-একটি নির্দিষ্ট তারার সাপেক্ষে চিহ্নিত করে থাকে । ২৭টি নক্ষত্রের মোট সময়কাল ২৭ দিন ৭৩⁄৪ ঘণ্টা। অতিরিক্ত ভগ্নাংশ সময়টি নিয়ন্ত্রিত হয় ২৮তম একটি নক্ষত্র দ্বারা, যার নাম অভিজিৎ। ঋগ্বেদের সময় (১৫০০ খ্রিঃপূঃ) থেকে নক্ষত্রের এই গণনা চলে আসছে।
২৭টি নক্ষত্রের নাম
অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব, ফাল্গুনী, উত্তর ফল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অণুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ, রেবতী।
করণ:
করণ হল তিথির অর্ধেক। সূর্য ও চাঁদের মধ্যে ০° থেকে ৬° কোণ সম্পূর্ণ করতে যে কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়, তা-ই হল করণ।
১টি তিথি = ২টি করণ। অর্থাৎ তিথি মোট ৩০টি হলে, করণের সংখ্যা মোট ৬০টি। কিন্তু ৩০টি তিথিকে সম্পূর্ণ করতে মোটে ১১টি করণই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
যোগ:
সংস্কৃত শব্দ যোগ-এর অর্থ ‘যুক্ত করা’, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যায় শব্দটি ‘শ্রেণিবদ্ধ করা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । প্রথম ক্ষেত্রে, মেষ রাশি বা মেষাদিকে আদিবিন্দু ধরে নিয়ে কোনো গ্রহের কক্ষপথের কৌণিক অবস্থান নির্ণয় করাহয় । একে ওই গ্রহের দ্রাঘিমা বলা হয়ে থাকে । তারপর সূর্যের দ্রাঘিমা ও চাঁদের দ্রাঘিমা যোগ করে, তাকে সরল করে ০° থেকে ৩৬০°-এর মধ্যে একটি মান নিয়ে আসা হয় (মান ৩৬০°-এর বেশি হলে, তা থেকে ৩৬০ বিয়োগ করা হয়)। এই যোগফলকে ২৭টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেকটি ভাগ ৮০০’-এর সমান (এখানে ’ বা মিনিট হল এক ডিগ্রির ১/৬০ অংশ)। এক-একটি ভাগকে যোগ বলা হয়।
২৭টি যোগের নাম
বিষ্কুম্ভ, প্রীতি, আয়ুষ্মান্, সৌভাগ্য, শোভন, অতিগণ্ড, সুকর্মা, ধৃতি, শূল, গণ্ড, বৃদ্ধি, ধ্রুব, ব্যাঘাত, হর্ষণ, বজ্র, অসৃক, ব্যতিপাত, বরীয়ান্, পরিঘ, শিব, সিদ্ধ, সাধ্য, শুভ, শুক্ল, ব্রহ্ম, মাহেন্দ্র, বৈধৃতি, সূর্যোদয়ের সময় যে যোগ চলমান থাকে, তাকেই সংশ্লিষ্ট দিনের যোগ ধরে নেওয়া হয়ে থাকে।
পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের ইতিহাস:
প্রথম নথিভুক্ত পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার গুলি হল ব্রোঞ্জ যুগের মিশরীয় এবং সুমেরীয় ক্যালেন্ডার।
বৈদিক যুগে ভারত বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের জন্য একটি অত্যাধুনিক ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। ইউকিও ওহাশির মতে, প্রাচীন ভারতের বেদাঙ্গ পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারটি বৈদিক যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এবং অন্য সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত হয়নি।
লৌহ যুগ থেকে শুরু হওয়া ব্যাবিলনীয় পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে,প্রাচ্যে প্রচুর সংখ্যক পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে ।পারস্য সাম্রাজ্যের পঞ্জিকা হতে জরথুস্ট্রিয়ান পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার এবং হিব্রু পঞ্জিকা জন্ম হয়েছিল।ধ্রুপদী গ্রীসে প্রচুর সংখ্যক হেলেনিক পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার তৈরি হয় এবং হেলেনিস্টিক যুগে প্রাচীন রোমান ক্যালেন্ডার এবং বিভিন্ন হিন্দু পঞ্জিকা জন্ম হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার দ্বারা রোমান পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার সংস্কার করা হয়। তার “জুলিয়ান” পঞ্জিকাটি আর নতুন চাঁদের পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল ছিল না, তবে প্রতি চার বছরে একটি লিপ ডে প্রবর্তন করে। এটি চন্দ্রাভিযান থেকে পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার মাসের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। ১৫৮২ সালে প্রবর্তিত,গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং সৌর বছরের মধ্যে অবশিষ্ট পার্থক্যের সংশোধন করে।
ইসলামিক ক্যালেন্ডার আন্তঃকাল (নাসি’) নিষিদ্ধ করার উপর ভিত্তি করে তৈরি। এর ফলে পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক চন্দ্র পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার তৈরি হয়।
আধুনিক ক্যালেন্ডারের সংস্কারের জন্য বেশ কিছু আধুনিক প্রস্তাব করা হয়েছে, যেমন বিশ্ব পঞ্জিকা , আন্তর্জাতিক স্থির পঞ্জিকা , হোলোসিন পঞ্জিকা এবং হ্যাঙ্কে-হেনরি স্থায়ী পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। এই ধরনের ধারণাগুলি সময়ে সময়ে উত্থাপিত হয়ে থাকে ।
আরো পড়ুন :কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম এবং দেনমোহরের গুরুত্ব ।
পরিশেষে:
বলা যাই যে, বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার হলো দিনসমূহকে হিসাব করার জন্য ব্যবহৃত হয় ।আশা করি আজকের এই আর্টিকেল থেকে আপনারা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার সম্পর্কে সকল তথ্য পেয়েছেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারের প্রয়োজন হয়ে থাকে।