আসসালামু আ’লাইকুম। আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভাল আছেন। বিভিন্ন ধরনের ভিনেগার বিভিন্ন ফল, শস্য দানা ইত্যাদি হতে তৈরি হয় আর ভেজানো আপিলের রস থেকে তৈরি হয় আপেল সিডার ভিনেগার। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় এই টনিক হচ্ছে আপেল সিডার ভিনেগার।স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এটি অনেক উপকারি। তবে এটি পরিমিত পর্যায়ে সেবন করা উচিত।
আপেল সিডার ভিনেগার:
ভিনেগার শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে সওয়ার ওয়াইন বা টক স্বাদ যুক্ত ওয়াইন। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আপেল সিডার ভিনেগার হচ্ছে ফার্মেন্টেড জুস্। আপেল পিষে যে রস বের করা হয় তা থেকে আপেল সিডার ভিনেগার তৈরি করা হয়।
একে তৈরি করতে আলকোহলীয় গাঁজন প্রকিয়া ব্যাবহার করা হয়। আপেলের শর্করা গুলো ভেঙ্গে আলকোহলে রূপান্তর করা হয়। এরপর আলকোহল ভেনেগারকে এসিটিক এসিড এ রূপান্তরিত করে। এসিটিক এসিড এবং মাণিক এসিড একত্রীত হয়ে ভিনেগারকে আর চেনা স্বাদ দেয়।
সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাই যে , আপেল সিডারের ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার ফলে যে ভিনেগার বা অম্ল-জাতীয় তরল পদার্থ উৎপন্ন হয়, সেটিই অ্যাপল সিডার ভিনেগার।
অ্যাপল সিডার ভিনেগারে উপকারিতা:
অ্যাপল সিডার ভিনেগারে রয়েছে প্রচুর উপকারিতা।যেমন –
- অ্যাপল সিডার ভিনেগারে রয়েছে পলিফেনল,এটি উদ্ভিদ যৌগ যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এই পলিফেনল শরীরের প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে।
- শরীরকে ফ্রি রেডিকেল এবং কোষের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করতে পারে। নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
- অ্যাপল সিডার ভিনেগার রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে।
- শরীরের অন্ত্রকে পরিষ্কার করে অ্যাপল সিডার ভিনেগার।
- ত্বকের ও চুলের সুরক্ষার জন্য উপকারী অ্যাপল সিডার ভিনেগার।
- অ্যাপল সিডার ভিনেগারে মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে মাউথওয়াশের ন্যায় কাজ করে।
আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার নিয়ম :
আপেল সিডার ভিনেগার সঠিক ব্যবহার বিধি এবং খাওয়ার নিয়ম না জানায় আপেল সিডার ভিনেগারের সুফল অনেকে পায় না। এজন্য ভাল করে এর ব্যবহারবিধি জেনে নেওয়া উচিত।
-
দাঁতের যত্নে
আপেল সিডার ভিনেগার দাতের যত্নে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। এটির পরিমাণ যদি বেশি হয় তাহলে দাঁতের ক্ষতি হতে পারেএবং দাঁতে ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে এটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিতে হবে। আপেল সিডার ভিনেগার সরাসরি ব্যবহার না করে পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা নিরাপদ। সরাসরি ব্যাবহারে এটি মুখের স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
-
পায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে
একটি তোয়ালে অথবা তুলোয় ভিজিয়ে একটা ফ্রিজে মুখ বন্ধ করা ব্যাগে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে এবং ঘরে ফিরে প্রতিদিন এই তুলো দিয়ে পা ভালো করে মুুছে নিতে হবে। এতে পায়ের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দূর হবে এবং পায়ের গন্ধ দূর হবে। আপেল সিডার ভিনেগার পায়ের ত্বকের পিএইচ মাত্রার পরিবর্তন করে এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি কে রোধ করে।
-
ওজন কমাতে
আপেল সিডার ভিনেগার জলের সঙ্গে মিশিয়ে পান করা যেতে পারে। যেমন, এক গ্লাস জলে ১/২ টেবিলচামচ (৫-১০ মিলিলিটার) ভিনেগার মিশিয়ে পান করা যায়। নিয়মিত আপেল সিডার ভিনেগার খাওয়ার ফলে পেটের মেদ কমার পাশাপাশি শরীরের অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস পাবে।
-
ক্যান্সার প্রতিরোধে
ক্যান্সার রোগীর রান্নায় আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা শাক সবজি দিয়ে তৈরি স্যালাড কিংবা ফল দিয়ে তৈরি স্যালাডে এর ব্যবহার করা যায়। উষ্ণ গরম এক গ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ টেবিল-চামচ ভিনেগার মিশিয়ে খাওয়া যায়।
-
পা ফাটা দূর করতে
পা ফাটা দূর করতে আপেল সিডার ভিনেগার হালকা গরম জলে ভালো করে মিশিয়ে, তাতে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট এর জন্য পা ভিজিয়ে রেখে তারপর পিউমিক স্টোন দিয়ে পায়ের মৃত কোষ গুলোকে তুলে ফেলতে হবে।
অন্যভাবে এক কাপ দই এর সাথে আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর এটি পায়ের ফাটা অংশে লাগিয়ে রাখতে হবে। কয়েক মিনিটের জন্য রেখে দিয়ে তারপর সেই জায়গাটা পিউমিক স্টোন দিয়ে ঘষে তুলে ফেলতে হবে। দিনে দুবার এটি ব্যবহার করতে হবে।এর পর পা ধুয়ে ভালো ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে রাখতে হবে।
-
হৃদপিন্ড সুস্থ রাখতে
এক গ্লাস উষ্ণ গরম পানিতে এক থেকে দুই চামুচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতিদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে খেয়ে নিতে হবে। এটি হৃদরোগের সমস্যার পাশাপাশি শরীরের অনেক সমস্যা কম করতে সহায়তা করবে। তবে এটি ব্যবহার করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ নিতে হবে।
-
ঠাণ্ডা-কাশি দূর করতে
ঠাণ্ডা বা কাশির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ আপেল সিডার ভিনেগার কুসুম গরম পানিতে মেশাতে হবে। এরপর সেই পানি দিয়ে গর্গল করতে হবে।
-
চুলের যত্নে
একটি বাটিতে জল এবং আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিতে হবে। এর পর এই মিশ্রণটি মাথার ত্বকে ভালো করে ম্যাসাজ করুন এবং ৫ মিনিটের জন্য রেখে হালকা গরম জলে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এটি ব্যবহার করতে হবে।
-
ত্বকের যত্নে
আপেল সিডার ভিনেগার এবং পানি ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার এই মিশ্রণটি স্প্রে বোতলে নিয়ে যেসব জায়গায় বলিরেখা দেখা দিয়েছে সেখানে স্প্রে করতে হবে অথবা তুলোয় করে নিয়ে সেই জায়গাতে লাগাতে হবে। এরপর ১০-১৫ মিনিট রেখে সাধারণ পানি দিয়ে মুখ ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।
-
মেচতা দূর করতে
আপেল সিডার ভিনেগারের সাথে জল মিশিয়ে যেখানে মেচেতার দাগ পড়েছে সেখানে তুলো দিয়ে লাগিয়ে রাখতে হবে। দিনে দুইবার এটি ব্যবহার করতে হবে। যতদিন না দাগটি সম্পূর্ণরূপে কমে যাচ্ছে প্রত্যেকদিন দুবার করে ব্যবহার করতে হবে।
-
ডায়াবেটিস নিরাময়ে
১ থেকে ২ টেবিল চামচ ভিনেগার উষ্ণ গরম পানিতে দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এটি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অথবা দুপুরে খাবার একঘন্টা পরে খেয়ে নিতে হবে । তবে খেয়াল রাখতে হবে, যদি এটি খাওয়ার পরে গলা জ্বালা, বুক জ্বালার মতো সমস্যা দেখা দেয় সেক্ষেত্রে এর পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে অথবা চিকিৎসকের পরমর্শ নিতে হবে।
-
অ্যালযাইমা রোগ নিরাময়ে
এই রোগীর খাদ্যতালিকায় আপেল সিডার ভিনেগারকে রান্নায় ব্যবহার করা যায়।এছাড়াও সালাড কিংবা শরবতে স্বল্প পরিমাণে আপেল সিডার ভিনিগার ব্যবহার করা যায়।।তবে এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
-
কিডনির সমস্যা দূর করতে
কিডনিতে যাদের পাথরের সমস্যা দেখা দেয় তারা নিয়মিত আপেল সিডার ভিনেগার পান করার অভ্যাস করতে পারে ।এটি শরীরের ভেতর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। তবে সরাসরি কখনোই গ্রহণ করা যাবে না। একগ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ টেবিল চামচ ভিনেগার মিশিয়ে গ্রহণ করতে হবে।
-
শরীরের গন্ধ দূর করতে
শরীরের গন্ধ দূর করতে আপেল সিডার ভিনেগার এক বালতি পানিতে অর্ধেক কাপ ভিনেগার মিশিয়ে নিয়ে গোসল করতে হবে। দিনের শুরুতে অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এটি ব্যবহার করা যায়।
-
দাঁদ হাজা কমাতে
আপেল সিডার ভিনেগারের ভেতর অল্প পানি মিশিয়ে মিশ্রনটিকে পাতলা করে নিতে হবে। এরপর যেখানে দাঁদ হাজার সমস্যাগুলি হয়েছে, সেখানে তুলো দিয়ে আলতো করে এটি লাগিয়ে রাখতে হবে।
আপেল সিডার ভিনেগার বানানোর নিয়ম :
১০টি আপেল ভালো ভাবে ধুয়ে প্রতিটি চার টুকরা করে কেটে নিতে হবে। আপেল বাদামি রং হওয়া পর্যন্ত রেখে দিন। বাদামি রং হয়ে গেলে একটি বড় কাঁচের জারে আপেলের টুকরা রাখুন এবং ১ কাপ পানিতে ১ চা চামচ চিনি মিশিয়ে জারে ঢালুন। আপেলের টুকরাগুলো পুরোপুরি পানিতে ডুবিয়ে দিন। প্রতি কাপে চিনি মেশাতে ভুলবেন না। আপেল পুরোপুরি পানিতে ডুবে গেলে ২ টেবিল চামচ সাদা ভিনেগার দিন। এবার টিসু দিয়ে জারের মুখ ঢেকে দিন। ভেতরে যেন বাতাস চলাচল করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখবেন।। ৩ সপ্তাহ পর জারটি খুলে আপেলের টুকরাগুলো উঠিয়ে ফেলুন। ভালো করে নেড়ে আবারও রেখে দিন। প্রতিদিন একবার চামচ দিয়ে নাড়তে হবে। ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর বের করে দেখুন টক স্বাদ এসেছে কিনা। চলে আসলে আপনার আপেল সিডার ভিনেগার তৈরি!
আরো পড়ুন :আকিকার গুরুত্ব ও ফজিলত এবং গোশত বিতরণের নিয়ম কানুন
পরিশেষে
বলা যায় যে ,আপেল সিডার ভিনেগার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক উপকারী। দৈনন্দিন স্বাস্থ্যসুরক্ষায় আপেল সিডার ভিনেগারের বহুমুখী গুণাবলির কথা বলে শেষ করা যাবে না। আশা করি, পরিমিত ব্যাবহারে এটির কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া হবে না।