আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছেন। বর্তমান সমাজে রক্ত চাপের রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সাময়িক পরিস্থিতিতে যেকোনো বয়সের মানুষেরই রক্তচাপ ঘটিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে কারণ শুধুমাত্র তাদের ব্যাস্ততার জীবন,রাস্তার ধারের ফাস্ট ফুড এবং সবথেকে প্রধান কারণ হচ্ছে অনিয়মিত জীবনশৈলী। এমনিতে রক্তচাপের রোগ খুবই সাধারণ দেখায় কিন্তু সেটার উপর নিয়ন্ত্রণ না পেলে সেই সমস্যা আরো বৃহৎ আকার ধারণ করে।এর ফলে হৃদজনিত সমস্যা, স্ট্রোক এবং কিডনির ও সমস্যা দেখাদেয় । উচ্চ রক্তচাপ বা নিম্ন রক্তচাপ উভয়ই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। সেই কারণে এখন অনেক চিকিৎসক ই নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষার কথা বলে থাকেন।

উচ্চ রক্তচাপ:

হাইপারটেনশন যার আরেক নাম উচ্চ রক্তচাপ হলো একটি রোগ যখন কোন ব্যক্তির হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি।উচ্চ রক্তচাপে এর চেয়ে বেশি থাকে। 

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ :

বিশ্বজুড়ে উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। উচ্চ রক্তচাপ-এর সমস্যায় রক্তের প্রবাহের অতিরিক্ত চাপ ধমনীর দেওয়ালে পরে। প্রাথমিক ভাবে  উচ্চ রক্তচাপের সেরকম কোনো বিশেষ লক্ষণ থাকে না। তাই অনেকে জানতে পারেন না যে তাদের এই সমস্যা আছে। উচ্চ রক্তচাপ মাপবার এবং জানবার একমাত্র উপায় হলো নিয়মিত রক্তচাপ মাপা। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে সমস্ত লক্ষণ দেখা যায় তা নিম্নরূপ –

  • মাথা ব্যাথা বা মাথা ঘোরা। 
  • শ্বাসকষ্ট ওবুকে ব্যাথা। 
  • অনিয়মিত হদ্স্পন্দন। 
  • বুকে ধড়পড় করা। 
  • কানের মধ্যে শব্দ করা। 
  • দৃষ্টি সম্পর্কিত সমস্যা। 
  • নাক দিয়ে রক্তপাত ইত্যাদি। 

উচ্চ রক্তচাপ কারণ:

শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপের কোন নির্দিস্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারী রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশী হয়ে থাকে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের ঝুকি বাড়ায়। যেমন-

বংশানুক্রমিক: 

উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে। যদি মা-বাবার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাহলে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে।

ধুমপান:

ধুমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।

অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: 

খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্ত চাপও বেড়ে যায়।

অধিক ওজন : 

যথেষ্ঠ পরিমানে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলে অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: 

অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন এবং ডুবা তেলে ভাজা খাবার খেলে আবার কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেষ্টরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেষ্টরল হলে রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।

অতিরিক্ত মদ্যপান: 

যারা নিয়মিত অত্যাধিক পরিমাণে মদ্যপান করে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশী হয়। অ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরী থাকে, এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস: 

ডায়াবেটিস রোগীদের অথারোসক্লেরোসিস বেশী হয়। ফলে বয়সের সাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। 

অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা: 

অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারনেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। 

অন্যান্য কারণসমূহ:

কিছু কিছু রোগের কারনে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারী হাইপারটেনশন।

এই কারণ গুলির মধ্যে কয়েকটি হলো:

  • কিডনীর রোগ।
  • ধমনীর বংশগত রোগ।
  •  অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারী গ্রন্থির টিউমার।
  • গর্ভধারন অবস্থায় এ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি এ্যাকলাম্পসিয়া হলে।
  • অনেকদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রনের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড গ্রহণ এবং ব্যাথা নিরামক কিছু কিছু ঔষধ সেবন করলে।

উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়:

জীবনযাত্রার কিছু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন করলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে পারি । যেমন-

লবণ কম খান :

উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না। আর রান্নাতেও যতটা সম্ভব লবণ কম দিন। অতিরিক্ত লবণ রক্তে মিশে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ায় এবং দেহে সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে রক্তচাপ হু হু করে বাড়তে থাকে। কিডনির উপরেও এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে।

অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলা:

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে উচ্চ রক্তচাপ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয় ।

নিয়মিত ব্যায়াম:

প্রতিদিন নিয়মিত ৩০ মিনিট ব্যায়ামে  রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ব্যায়ামের সময় হৃদপিণ্ড শক্ত হয় এবং পাম্প করতে চাপ কম লাগে। যা আর্টারি প্রেশার কমিয়ে উচ্চ রক্তচাপ কমায় দেয় ।

চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করুন :

উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। তবে শুধু খাবারের কোলেস্টেরলই রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ানোর জন্য দায়ী নয়। 

আঁশযুক্ত খাবার বেশি খান :

সবজি এবং ফলমূল শরীরের জন্য উপকারী। এগুলো রক্তে কোলেস্টেরলও কমায়। দ্রবণীয় আঁশ পরিপাক নালি থেকে স্পঞ্জের মতো কোলেস্টেরল শুষে নেয়।  শিম, বার্লিতে প্রচুর আঁশ থাকে।

মদ্যপান পরিহার করুন :

অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। অ্যালকোহল  রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। মদ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।

ধূমপান পরিহার করুন :

রক্তে উপকারী কোলেস্টেরল বা বেশি ঘনত্বের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ধূমপান। রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে অবশ্যই ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে।

নিয়মিত রক্তচাপ মনিটর করুন:

উচ্চ রক্তচাপ রোগীর নিয়মিত রক্তচাপ মনিটর করতে হবে এবং যেকোনো শারীরিক অসুস্থতায় দ্রুত চেকআপ করাতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, মানসিক সুস্থতার জন্য ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্ট শান্তিপূর্ণ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।উচ্চ রক্তচাপ রোগী ঠিকমতো মেডিসিন খাচ্ছে কিনা, হেলদি ফুডচার্ট মেনে চলছে কিনা, সেটা পরিবারের সদস্যদেরও খেয়াল রাখা উচিত।

টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা :

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত কাজের প্রেশার, আর্থিক অবস্থার অবনতি, পারিবারিক কলহ বা অসুস্থতা ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপের কারণ কী তা খুঁজে বের করতে হবে এবং আগে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বিশ্রাম নিতে হবে :

সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ৬ ঘন্টার কম ঘুমালে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া বা স্লিপিং ডিজঅর্ডার, সাধারণ নিদ্রাহীনতা। ইনসমনিয়া, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এসব সমস্যার কোনোটিতে ভুগে থাকলে তা চিহ্নিত করে নির্মূল করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তার যদি ঘুমের জন্য মেডিসিন দেন, তাহলে সেটা নির্দিষ্ট ডোজে নিতে হবে। 

উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ওষুধের ভূমিকা:

উচ্চ রক্তচাপে ইতিমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে। কিছু ওষুধ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে থাকে ।

আরো পড়ুন :দ্রুত পেট ব্যাথা কমানোর ঘরোয়া উপায়।

পরিশেষে 

বলা যাই যে উচ্চ রক্ত চাপ বহুল পরিচিত একটি সমস্যা।সচেতনতা ,নিয়মতান্তিক জীবনযাপন ,সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের ফলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। উচ্চ রক্ত চাপকমানোর উপায় সমূহ যথা যোথ ভাবে মেনেচললে এবং বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ মানলে সুস্থ ভাবে জীবন যাপন সম্ভবপর হবে। 

Write A Comment