আসসালামু আলাইকুম আশা করি ভালো আছেন। আমাদের ইসলাম ধর্মের ইতিহাস যতটা প্রাচীন, ততটাই প্রাচীন কোরবানির ইতিহাস। মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ ও দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা আর আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য লাভের ও সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম কোরবানি। এই পন্থায়  ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে মানুষের সর্বাধিক প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হয়। পশু কোরবানির ফলে অন্তর হবে পরিশুদ্ধ। আর এটাই হলো কোরবানির মূল প্রেরণা।

কোরবানি:

শুধু আত্মত্যাগই নয় বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার অনন্য একটি  নিদর্শন হচ্ছে  কোরবানি। কোরবানি মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আদম (আ.) থেকে শুরু করে সব নবীর যুগেই কোরবানি পালন করা হয়েছে । এটি ‘শাআইরে ইসলাম’ তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত। সামর্থ্য বান ব্যক্তিগনের ওপর কোরবানি ওয়াজিব।

আল্লাহ ও তার রাসূলের শর্তহীন আনুগত্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষাও রয়েছে কোরবানিতে। নবীজীকে আল্লাহতাআলা নির্দেশ দিয়েছেন যে – আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাওসার:২)

অন্য আয়াতে এসেছে- (হে রাসূল) আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামিনের জন্য উৎসর্গিত করলাম । (সুরা আনআম: ১৬২)।

কোরবানির গোশত বন্টনের হাদিস :

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করা পশুর গোশত ভাগ করার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। মহানবী (সাঃ) কোরবানির পশুর গোশত ভাগ করার নিয়ম সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

لِّيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۖ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ

অর্থ: ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও।’ (সূরা: হজ, আয়াত ২৮)।

وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا صَوَافَّ فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذَلِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

অর্থ: ‘আর কাবার জন্য উৎসর্গীকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও; যে কিছু চায় না তাকে এবং যে চায় তাকেও। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা: হজ, আয়াত ৩৬)।

উল্লেখিত আয়াতে থেকে সুস্পষ্ট যে, কোরবানির গোশত মোটামুটি  ভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করার একটি নির্দেশনা বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহলো-

(১) কোরবানি দাতা নিজেদের জন্য রাখবে তথা আহার করবে ।

(২) আত্মীয়-স্বজনদের এক ভাগ দেওয়া।

(৩)যারা অভাবি বা গরিব (তারা চায় বা না চায়) তাদের এক ভাগ দেওয়া।

কোরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম :

কোরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম সমূহ-

বর্তমান সময়ে  আমাদের সমাজে কোরবানির গোশত বণ্টনের অনেকগুলি নিয়ম দেখা যায়। যেগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোরআন হাদিসের সাথে মিল নেই। অনেক জায়গায় আবার ব্যক্তি কোরবানি দিয়ে সব গোশত নিজ পরিবারের জন্য সংরহ করে রেখে দেন।এটা সঠিক নয়। 

কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের বলে যাওয়া তথ্য অনুযায়ী কোরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম দেখে নেয়া যাক ।

  • কোরবানির গোস্ত বিতরণের মুস্তাহাব ও উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে  তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনদের জন্য এবং এক ভাগ পাড়া প্রতিবেশী গরিব মিসকিন দের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন আলেমদের মতে এটা মুস্তাহাব।
  • নিজ পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় গোশত রেখে বাকি সকল গোশত পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন এবং গরিব মিসকিন দের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে।
  • নিজ পরিবারের লোক সংখ্যা যদি বেশি হলে আর গোশতের পরিমান কম হলে পুরোটাও নিজ পরিবারের জন্য রেখে দেওয়া যাবে। এটি জায়েজ হবে ।
  • ব্যক্তি চাইলে কোরবানি করে সম্পূর্ণ কোরবানির গোশত বিলিয়ে দিতে পারবেন। এটাও জায়েজ।

আবার একেবারে তিনভাগ সমান হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ফকির বেশি হলে সেই ভাগ বেশি হতে পারে। আত্মীয় বেশি হলে ওই ভাগও বেশি হতে পারে।  আত্মীয়  কম হলে ওই ভাগ কম হতে পারে। আবার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলে ওই ভাগও বড় হতে পারে, আবার সদস্য সংখ্যা কমও হতে পারে। চাহিদা অনুযায়ী হবে ভাগ। ভাগের জন্য একদম কোনো শর্ত নেই। এইগুলো রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাহ বা আদর্শ হবে। তিনভাগ করা উত্তম এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবার কেউ যদি নিজেদের জন্য রেখে দেন তাতে যে কুরবানি হবে না এই কথা ও ঠিক নয়। তবে এমনটা করলে, কুরবানির মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে । কারণ কুরবানি আপনি আল্লাহর জন্য করেছেন।

কোরবানির গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় লক্ষণীয়:

কোরবানির মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির মনকে পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। হাদিস পাওয়া যাই যে ,মন পবিত্র থাকলে, কিংবা কোরবানির জন্য ক্রয় করা পশু হালাল টাকার হলে কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগে আল্লাহর কাছে তার তাকওয়া পৌঁছে যায়। ।

তবে, নিজের মনকে পরিশুদ্ধ রাখতে হবে। এছাড়াও কোরবানির গোশত বণ্টনে যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন তা হলো –

  • আপনার কুরবানীর গোস্ত  কাছের গরিব, মিসকিন, পাড়া প্রতিবেশী, এবং আর্থিক ভাবে আপনার থেকে অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ যেন বাদ পরে কষ্ট না পায়।
  • আপনার থেকে সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে কোরবানির গোশত দেওয়া তেমন জরুরি না।
  • আত্মীয় স্বজনরা যেন কোরবানির গোশত থেকে কোন ভাবেই বাদ না পরে সে দিক লক্ষ্য রাখা।
  • কোরবানি দেওয়ার উদ্দেশ্য যেন শুধু মাত্র গোশত দিয়ে ফ্রিজ পূর্ণ করে না রাখা।
  • কোরবানির উদ্দেশ্য যেন হয় আল্লাহকে সন্তুষ্টি এবং নিজেকে পরিশুদ্ধ করা।

কোরবানির গোশত বণ্টনের নিয়ম সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্তর:

(১) কোরবানির মাংস কতদিন পর্যন্ত রাখা যাবে?

কোরবানির গোস্ত রেখে রেখে না খাওয়াটাই অতি উত্তম। তবে দীর্ঘদিন কোরবানির গোস্ত রেখে খাওয়া যাবে না।যত  তারাতারি সম্ভব গোস্ত শেষ কোনো হবে। 

(২)কোরবানির গোস্ত কয় ভাগে ভাগ করতে হবে?

কোরবানির গোস্ত ভাগ করার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি বিষয় নির্ভর করে। তবে সমান তিন ভাগে কোরবানির মাংস ভাগ করে বিলি করার বিধান রয়েছে। এটি জায়েজ। এছারা ও আরও উপায় উপরে উল্লেখ করা হয়েছে ।

(৩) কোরবানির গরুর ভাগের নিয়ম কি?

একটি গরুর থেকে শাতটি ভাগে কোরবানি দেওয়া যাবে । অর্থাৎ, একটি গরু থেকে সর্বাধিক ৭ জনে কোরবানি দিতে পারবেন। 

(৪) মহানবী( সাঃ) কিভাবে কোরবানির গোশত ভাগ করতেন?

মহানবী (সাঃ) নিজের জন্য এক বেলা রান্নার মত কিছু পরিমান গোশত রেখে বাকি সব এতিম, মিসকিন সহ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

(৫) ছাগল দিয়ে কোরবানি দিলে কি হবে?

হ্যা। ছাগল দিয়ে কোরবানি দেওয়া যাবে এবং ছাগলের ক্ষেত্রে অন্তত এক বছর বয়স হতে হবে। এবং হৃষ্টপুষ্ট সুস্থ সবল ছাগল হতে হবে।

(৬)ধনীদের ও অমুসলিমদের কোরবানির গোস্ত দেওয়া যাবে?

এটা যেহেতু কোরবানিদাতার নিজস্ব সম্পদ, তাই তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে উপহার হিসেবে দিতে পারবেন। ইসলামি আইনবেত্তা ফকিহদের অভিমতও এটাই।আবার কোরবানির গোস্ত অন্য ধর্মাবলম্বীকেও দেওয়া জায়েজ। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) তার ইহুদি প্রতিবেশীকে দিয়ে গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং ১২৮)।

(৭)কোরবানির গোস্ত দান না করলে কি ক্ষতি হয় ?

কোরবানি পশুর মতো তার গোস্তর মালিকানাও কোরবানিদাতার। সেক্ষেত্রে ওই গোস্ত নিজে খাওয়া কিংবা কাউকে দেওয়া একান্তই  তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে । তিনি চাইলে যেমন পুরোটাই বিতরণ করে দিতে পারেন, আবার চাইলে পুরোটা খাওয়ার অধিকারও তার আছে। কিন্তু  কুরবানীর গোস্ত বিলিয়ে দেয়া উচিত । 

কুরবানী গোস্ত বিতরণে সতর্কতা:

কুরবানী গোস্ত বিতরণে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত –

(১)মানতের কোরবানির গোস্ত  :

মান্নতের কোরবানির গোস্ত পুরোটাই বিতরণ করতে হবে। মান্নতের কোরবানির গোস্ত মানতকারী ও তার পরিবার খেতে পারবে না।  তার পুরোটাই দান করে দিতে হবে এবং যারা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত শুধু তাদেরকেই দেওয়া যাবে, ধনীদের দেওয়া যাবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৫ ও রদ্দুল মুহতার : ৩/৭৩৭)

(২)সামাজিকভাবে কোরবানির গোস্ত বিতরণে ভুল প্রচলন:

আমাদের কিছু সমাজে প্রচলিত আছে সকল কোরবানিদাতাদের থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ (যে অংশ গরিবদের জন্য রাখা) গোস্ত  সংগ্রহ করে তা আবার সমাজের প্রতিটি ঘরে বণ্টন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কোরবানিদাতা চক্ষুলজ্জার ভয়ে কিংবা সামাজিক চাপে পড়েই গোস্ত দিতে বাধ্য হন। একইসঙ্গে এক্ষেত্রে ধনী, গরিব এমনকি স্বয়ং কোরবানিদাতাও ওই গোশতের ভাগ পান। কিন্তু সমাজে অনেকের কোরবানি মানতের থাকে, যার মাংসে শুধু গরিবদের অধিকার। তাই এ পদ্ধতি জায়েজ নেই।

তবে যদি মানতের না হয়, কোরবানিদাতা স্বেচ্ছায় এখানে মাংস দেন এবং তা শুধু গরিবদের মাঝেই বিতরণ করা হয়, তাহলে এটা জায়েজ হবে। (দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইট, ফতোয়া নং : ১৫৩৮৩১)

(৩) কোরবানিকৃত পশুর পা-মাথা ভাগের ক্ষেত্রে করণীয়:

একাধিক শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে মাংস বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। পা ও মাথার ক্ষেত্রেও একই বিধান। তবে কেউ যদি নিজের ভাগের অংশ অন্যজনকে দিয়ে দেয়, তাতে সমস্যা নেই (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৭, কাজিখান : ৩/৩৫১)।

(৪) আকিকার মাংস বণ্টনেও একই বিধান:

আকিকার গোস্ত সন্তানের মা-বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং ধনী-গরিব সবাই খেতে পারবেন। আকিকার গোশতর বণ্টন ও ব্যবহার কোরবানির মতোই। কিছু নিজেদের জন্য রাখা, কিছু আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া এবং কিছু সদকা করা উত্তম (ইলাউস সুনান : ১৭/১১৮, ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩০৪)।

আরো পড়ুন :তালাকের নিবন্ধন সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম।

পরিশেষে :

বলা যায় যে , আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের কোরবানিকে কবুল করে নিন এবং সবাইকে সঠিক ভাবে কোরবানি আদায় করার তৌফিক দান করুন।আশা করি ,কোরবানির গোশত বণ্টনের নিয়ম সম্পর্কে ,এই পোস্ট থেকেসম্পূর্ণ জানতে পেরেছেন।

Write A Comment