আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক,  আশা করি ভালো আছেন সবারই জানা উচিত জানাজার নামাজের নিয়ম । আমরা কেউ চিরজীবী নই, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানে বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে’। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত জানাজার নামাজের নিয়ম জেনে সঠিক পদ্ধতিতে জানাযার নামাজ আদায় করা। আজ আমরা জানাযার নামাজের নিয়ম  সম্পর্ক জানবো এই আর্টকাইলটিতে।

জানাযার নামাজ :

একজন ইমামের নেতৃত্বে জামাতের সাথে বা দলবদ্ধভাবে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।  জানাযার নামাজে অংশগ্রহণকারীরা বেজোড় সংখ্যক কাতারে বা সারিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এ নামায আদায় করেন। এটি ৪ তকবিরের নামাজ। দাঁড়িয়ে এ নামাজ আদায় করতে হয় এবং সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়ে এ নামায শেষ হয়। সাধারণত জানাযার নামাযের শেষে মুনাজাত বা দোয়া করতে হয় না। কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিধান অনুযায়ী মৃতের জন্য এ নামাযের মাধ্যমেই দোয়া করা হয়। জানাযা শেষে মৃতব্যক্তিকে অবিলম্বে গোরস্থানে নিয়ে যেতে হয় এবং ইসলামী রীতিতে কবর তৈরি করে মাটিতে দাফন করা  হয়।

জানাজার নামাজের ফজিলত ও হাদিস:

ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে মাইয়্যাতের জানাজা পড়া এবং দাফন পর্যন্ত কবরস্থানে অপেক্ষা করা সুন্নাত।প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এরশাদ করেছেন, 

“যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে সে এক ‘কীরাত’ পরিমাণ নেকি অর্জন করে। আর যে ব্যক্তি কোনো মৃত মানুষের জানাজার নামাজ আদায় করে এবং তারপর দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করে, সে দুই ‘কীরাত’ পরিমাণ সওয়াব লাভ করে।”ঐ  সময় কোনো এক সাহাবি প্রশ্ন করে উঠলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই কীরাত কী?’ মুহাম্মদ (সা.) বললেন, ‘দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কীরাত হলো উহুদ পাহাড়ের সমান।’(ইবনে কাছির)

 রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জানাজায় এমন চল্লিশজন লোক যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করেননি, যদি শরীক হয়ে ঐ লাশের জন্য দোয়া করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাদের সুপারিশ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।’ (সহীহ মুসলিম ও মিশকাত)

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘যখন কোনো মুসলমানের ইন্তেকাল হয় এবং একশ জনের কাছাকছি সংখ্যক মুসলমান তার জানাজার নামাজ পড়ে ও তার জন্য সুপারিশ করে তো এই সুপারিশ কবুল করা হয়’। (জামে তিরমীযি)

জানাজার নামাজ কত বার পড়া যায়:

জানাজা মূলত একবারই হবে। জানাজা দুই বা তিনবার করার দরকার নেই। 

কিন্তু যদি এমনটা হয় যে, একজন বিদেশে মারা যাওয়াতে বিদেশের লোকেরা তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করতে চায় কেননা তাদের পক্ষে তার দেশে যাওয়া সম্ভব না। আবার দেশে গেলে সেখানকার লোকেরা আবার জানাজা পড়তে চায় তাই সেটা বিশেষ কারণে হয়তোবা হতে পারে। তবে একবার হওয়াটাই হচ্ছে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ এবং ইহাই মূলত আজকের এই যুগ পর্যন্ত সালফেস সালেহিনের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। 

তবে কোনো সময় যদি এরকম বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে একাধিকবার কেউ জানাজা পড়ে থাকে, তাহলে কোনো গুনাহ নেই। 

মৃত ব্যক্তির জানাজার ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর হাদিসের মাধ্যমে যেটা সাব্যস্ত হয়েছে তা হলো, জানাজা একবারই হবে। তবে বিশেষ কারণ অথবা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যদি কারো জানাজা দ্বিতীয়বার করার দরকার হয়, তাহলে সেটিও জায়েজ।

জামাআত যেভাবে দাঁড়াবে :

জামাআতের সামনে কাফন ঢাকা লাশ রাখতে হবে। তার পেছনে লাশের সিনা বরাবর ইমাম দাঁড়াবেন। তার পেছনে মুক্তাদীরা কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবেন। সবাই মনে মনে ইচ্ছা করবেন : এই মৃত ব্যক্তির দোয়ার জন্য জানাজার নামাজ পড়ছি। মূলত এটাই হল নিয়ত।

জানাজা নামাজের নিয়ম :

বুখারী শরীফের হাদিস এসেছে, “সবাই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে জানাজার ফরজ আদায়ের নিয়ত করবে।” কুরআন- সুন্নাহ মোতাবেক জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম গুলো হলো-

  • জানাজার নামাজে ইমাম মৃতের বক্ষ বরাবর দাঁড়াবে। 
  • ইমামের পেছনে মুক্তাদিদের কাতার হবে।
  • প্রথম তাকবির শেষে ছানা পড়া। মনে রাখবেন, জানাজার নামাজের ছানা সাধারণ নামাজের ছানার চেয়ে কিঞ্চিত আলাদা হয়। 
  • নামাজে আমরা যে দরুদে ইব্রাহিম পড়ি দ্বিতীয় তাকবিরের পর সেই দরুদ পড়া।
  • তৃতীয় তাকবির শেষ হলে দোয়া পড়া। মৃত ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক নাকি অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং নারী বা পুরুষ সে অনুযায়ী দোয়া পড়তে হবে।  
  • দোয়া শেষে চতুর্থ তাকবিরের পর সালাম ফিরিয়ে জানাজার নামাজ শেষ করা।

যদি কারো নামাজে আসতে দেরী হয়ে যায়, তবে ইমাম সাহেবকে অনুসরণ করতে হবে। সম্ভব হলে চার তাকবীর আদায় করে নিতে হবে, তা যদি সম্ভব না হয়, তবে ইমাম সাহবকে অনুসরণ করে সালাম ফিরিয়ে নিয়ে জানাজা নামাজ সম্পন্ন করবে। জানাজা নামাজ জামাতে আদায় করতে হয়, তাই এটি কাজা পড়ার সুযোগ নেই।

জানাযার নামাজের নিয়ত আরবিতে :

نَوَيْتُ اَنْ اُؤَدِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى اَرْبَعَ تَكْبِيْرَاتِ صَلَوةِ الْجَنَا زَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَا ءُ لِلَّهِ تَعَا لَى وَالصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَالدُّعَا ءُلِهَذَا الْمَيِّتِ اِقْتِدَتُ بِهَذَا الاِْمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ

বাংলা উচ্চারণ:

 “নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তায়ালা আরবা আ তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।”

এখানে নিয়তে ‘লেহাযাল মাইয়্যেতে’ পুরুষ/ছেলে লাশ হলে পড়তে হবে, আর লাশ নারী/মেয়ে হলে ‘লেহাযিহিল মাইয়্যেতে’ বলতে হবে।

জানাযার নামাজের নিয়ত বাংলাতে :

নিয়ত আরবিতে করতে না পারলে বাংলায় করলেও চলবে, ‘আমি চার তাকবিরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাযার নামাজ কিবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে মরহুম ব্যক্তির (পুরুষ/মহিলার) জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।জানাযার নামাজে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও রাসূলের ওপর দরুদ পাঠ করা হয়। বাংলায় নিয়ত করলে তা বাংলায় বলে অথবা মনে মনে নিয়তে আনলেও চলবে।নিয়তে তাকবীরে তাহরিমা অর্থাৎ, আল্লাহু আকবার বলার পর হাত তুলে তারপর অন্যান্য নামাজের মতো হাত বেঁধে নিতে হবে। হাত বেধে সানা পড়তে হবে।

আরবিতে সানা:

سُبْحَا نَكَ اَللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَا لَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَلاَ اِلَهَ غَيْرُكَ

বাংলা উচ্চারণ:

সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানাউকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

সানা পড়ার পরে তাকবীর বলে দরুদ শরীফ পড়তে হবে যেটা সাধারণ নামাজে তাশাহুদের পর পড়া হয়।

দরুদ শরীফ:

للَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَ اهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ- اَللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى اَلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى اِبْرَا هِيْمَ وَعَلَى اَلِ اِبْرَا هِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌمَّجِيْدٌ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদি ওয়া আলা আলি মুম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামিদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহিমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহিমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ।

দরুদ শরীফ পড়ার পর তৃতীয় তাকবীর আদায় করে জানাযার দোয়া পড়তে হয়।

জানাযার দোয়া:

لَّهُمَّ اغْفِرْلحَيِّنَاوَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَا نَا اَللَّهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلَى الاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الاْيمَانِ بِرَحْمَتِكَ يَا ارْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ও ছাগীরিনা ও কাবীরিনা ও যাকারিনা ও উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামী ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ঈমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহীমিন।

তবে নাবালক ছেলের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া পড়তে হবে,

اَللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وْاَجْعَلْهُ لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَمُشَفَّعًا

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মাজ আল হুলানা ফারতাও ওয়াজ আল হুলানা আজরাও ওয়া যুখরাঁও ওয়াজ আলহুলানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ্ফায়ান।

নাবালিকা মেয়ের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া পড়তে হবে,

اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًاوَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفَّعَة

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মাজ আলহা লানা ফারতাও ওয়াজ আলহা লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়াজ আলহা লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফ ফায়ান।

আরো পড়ুন :তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব,রাকআত,সময়,নিয়ত এবং নিয়মসমূহ।

পরিশেষে :

বলা যায় যে,জানাজার নামাজের নিয়ম ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করা হল।মানুষ চিরজীবী নয়। প্রত্যেক মানুষকে একদিন পরপারে যেতে হবে। যে শিশুর আজ জন্ম হলো তাকেও একদিন না একদিনএই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তে হবে, যেতে হবে পরপারে। এই নির্দিষ্ট সময়ের পৃথিবীটি মানুষের জন্য পরীক্ষা।উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানাজার নামাজে শরীক হওয়াতে নিজের ও মৃত ব্যক্তির লাভের কথা জানলাম।

Write A Comment