আসসালাম আ’লাইকুম। আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভাল আছেন।শুরুতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখা ভালো মুখে তালাক বললেই তালাক হয় না।মুখে তালাকের ঘোষণার পাশাপাশি লিখিত নোটিশ পাঠাতে হবে৷ আইনী বৈধতা জরুরী যেমন বিয়ে করার ক্ষেত্রে তেমনি তালাকের ক্ষেত্রেও বৈধতা জরুরী। আমাদের দেশের আইনমতে, কেউ যদি ডিভোর্স বা তালাক দিতে চায় তবে মুখে ‘তালাক’ বলার পর তালাক সংক্রান্ত লিখিত নোটিশও দিতে হয় । যাকে তালাক দেয়া হবে সে স্বামী বা স্ত্রী যাই হোক, তাকে নোটিশ দিয়ে তালাকের বিষয়ে অবগত করতে হবে।  এর পাশাপাশি একই নোটিশ যাকে তালাক দেয়া হয় তার এলাকার চেয়ারম্যান বরাবরে পাঠাতে হয় ।

তালাক:

শরিয়তে তালাক অনুমোদিত হলেও এটি বৈধ কাজগুলোর মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত কাজ বলে হাদিসে উল্লেখ হয়েছে। তালাক  আরবি শব্দটির অর্থ বন্ধনমোচন বা ভাঙ্গন। ইসলামি পরিভাষায় বিধি সম্মত বিয়ে দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করার নাম তালাক। অবস্থাভেদে স্বামী ও স্ত্রী উভয় পক্ষ থেকে তালাক দ্বারা বিবাহবন্ধন ছিন্ন হতে পারে। 

তালাকের প্রকারভেদ

মুখে শুধু তিন তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক কার্যকর হয় না। আবার লিখিত ভাবে তালাক দিলেও সাথে সাথে তা কার্যকর হয় না। আইনের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করার পর তালাক কার্যকর হয় ।তালাকের আইন অনুযায়ী তালাক কার্যকর হয়।

  • স্বামী কর্তৃক তালাক

স্বামীর সবচেয়ে বেশি অধিকার বা ক্ষমতা তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে।  কোন কারন ব্যতীত স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে।

  • স্ত্রী কর্তৃক তালাক

স্ত্রীর কম থাকে তালাক দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা। আইনে উল্লেখিত কারণ ব্যতীত স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না।তবে কাবিন নামার ১৮ নং কলামে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বিয়ে বিচ্ছেদের ক্ষমতা দেওয়া থাকলে (তালাক-ই-তৌফিজ) স্ত্রী তালাক দিতে পারবে।

  • পারস্পারিক সম্মতিতে তালাক

এ ক্ষেত্রে দুই ভাবে তালাক হয়-

১) খুলা – স্ত্রী তার স্বামীকে যেকোন কিছুর বিনিময়ে তালাক দেওয়ার জন্য রাজি করাবেন।

২) মুবারত- স্বামী স্ত্রী উভয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।

  • আদালত কর্তৃক বিচ্ছেদ

এ ক্ষেত্রে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে ডিভোর্স বা তালাক নেওয়া।

যে  কারণে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন:

মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ ১৯৩৯ সালের  আইনে অত্যান্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কোন কোন কারণে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন।

  •  স্বামী চার বছর পর্যন্ত নিরুদ্দেশ থাকলে।
  • স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দুই বছর দিতে ব্যর্থ হলে।
  • স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়ে বেশী কারাদণ্ড হলে।
  • কোন যুক্তি সংগত কারণ ব্যতীত স্বামী তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
  • বিয়ের সময় স্বামী পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায় করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
  • দুই বছর ধরে স্বামী পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
  • কোন মেয়ের বাবা বা অভিবাবক যদি মেয়ের বয়স ১৮ বছর  হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তাহলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক(সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে।
  • ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লংঘন করে স্বামী একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
  • স্বামী স্ত্রীর সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে।

উপরের যেকোন এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে।

তালাকের নিয়ম 

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭ (১) ধারা অনুযায়ী, যে কারনে  তালাক ঘটুক না কেন, যে পক্ষ তালাক দিতে চাইবে সে পক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপর পক্ষের ঠিকানা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে  লিখিত ভাবে নোটিশ পাঠাতে হবে । সেই নোটিশের কপি অপর পক্ষের কাছেও পাঠাতে হবে। তবে আদালতের মাধ্যমে কোনো তালাকের ডিক্রি হলে সে ডিক্রির কপি চেয়ারম্যানকে প্রদান করলেই  ধরে নেওয়া হবে নোটিশ পাঠানো হয়েছে ।

 তালাকের নোটিশ স্বামী বা স্ত্রী নিজে লিখিত আকারে পাঠাতে পারে । তবে 

 নিয়ম কানুন ঠিক রেখে নোটিশ পাঠাতে হবে। আইনের ৭ (১) ধারা অনুযায়ী,যে পক্ষ থেকেই তালাকের নোটিশ দেওয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়র নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সালিসি পরিষদ গঠন করবেন। সালিসি পরিষদ উভয় পক্ষকে পরপর তিনটি লিখিত নোটিশ পাঠিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করবে। নোটিশ পৌঁছানোর তারিখ থেকে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে তালাকের নোটিশ পাঠানো মানে হচ্ছে তালাকের ঘোষণা। নোটিশ পাঠালেই তালাক কার্যকর হয়ে যায় না। একই আইনের ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, তালাকের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পালন না করলে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে । 

তালাক নিবন্ধন

যে পক্ষই তালাক প্রদান করুক না কেন, তালাক কার্যকরের পর তালাকটি অবশ্যই নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করাতে হয় কাজি অফিসে। কোনো কারণে কোনো পক্ষ তালাক নিবন্ধন অস্বীকার করলে ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্ট্রারের কাছে আপিল করা যায়। তবে তালাক নিবন্ধন নিয়ে কোনো জালিয়াতি করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ।

আরো পড়ুন :পেটের মেদ কমানোর এলোপ্যাথি ,আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও ঘরোয়া উপায়

পরিশেষে

বলা যাই যে , তালাক বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।  স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি তালাকের প্রয়োজন দেখা দেয় তবে অভিজ্ঞ উকিলের পরামর্শ গ্রহন করাই যুক্তিযুক্ত।

Write A Comment