আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে সবাই ভালো আছেন। বিতর আরবি ‘আল-বিতরু’ শব্দ থেকে উদ্ভুত। এর শাব্দিক অর্থ বেজোড়। বিতর নামাজকে বিতর বলার কারণ এ নামাজ রাকাত বিধায় একে বিতর বলা হয়। কেননা বিতর নামাজ বেজোড়। বর্ণনাভেদে বিতর নামাজ তিন বা এক রাকাত। ইশার নামাজের পরপরই এ নামাজ পড়া ওয়াজিব।হাদিস শরিফে বিতর নামাজের রাকাত ও ধরন নিয়ে বর্ণনার বৈচিত্র রয়েছে। বিতরের নামাজ পড়ার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ তাগিদ দিয়ে বলেন, বিতরের নামাজ পড়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বিতর আদায় করবে না, আমাদের জামাআতের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। (আবু দাউদ)

বিতর নামাজ :

বিতর,  الوتر আরবি শব্দ যার বাংলা অর্থ বিজোড়। صلاة الوتر বিজোড়ের নামাজ তথা বিতর নামাজ কে বোঝানো হয়। যা প্রত্যেক মুসলিমনর-নারীর ওপর প্রতিদিন এশার নামাজের পর থেকে ফজরের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আদায় করা ওয়াজিব।

কেননা রাসূলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম হাদিসে পাকের মধ্যে এরশাদ করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিজোড় এবং তিনি বিজোড় নামাজকে পছন্দ করেন। অতএব তোমরা বিজোড় সালাত (বিতর সালাত) আদায় কর। তিরমিজি

বিতর নামাজের নিয়ত:

নিয়ত মানে হচ্ছে মনের সংকল্প। প্রায় সকলেই নিয়ত সম্পর্কে আমরা ভুল করে থাকি। নিয়তের ক্ষেত্রে আমরা আরবি নিয়ত কে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। মূলত বিষয়টি এরকম নয় নিয়ত নিজ মাতৃভাষায় করাটা অনেক ক্ষেত্রে আরবি থেকে উত্তম।

কেননা আরবি গ্রামারের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমাদের না থাকায় নিয়তের মধ্যে অনেক ভুল করে থাকি। কিন্তু দেখুন নিজ ভাষায় যখন নিয়ত করবেন তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।যাই হোক আমরা আপনাদের সাথে বিতর নামাজের আরবি এবং বাংলা উভয় নিয়তই বলবো ।

বিতর নামাজের বাংলা নিয়ত:

বিতর নামাজের নিয়ত ফরজ নামাজের ন্যায় ৩ ভাবে হতে পারে (একাকী, জামাত বন্দী হয়ে এবং নিজে ইমাম হলে)। তাই এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে আপনাকে ভিন্নভাবে নিয়ত বাঁধতে হবে।

  • ইমাম হয়ে নামাজ পড়ালে

নিয়তের ধরন হবে কিছুটা এরকম ’’কেবলামুখী হয়ে ৩ রাকাত বিতর নামাজ পড়াচ্ছি।’’

  • ইমামের পিছনে নামাজ পড়লে: 

’’আমি কেবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে ৩ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করছি ।’’

  • একাকী হলে: 

তখন নিয়ত টি হবে কিছুটা এরকম ’’আমি কেবলামুখী হয়ে ৩ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করছি ।’’

বিতর  নামাজের আরবি নিয়ত: 

নাওয়াইতুয়ান য়া ওসল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা সালাসা রাকায়াতি সালাতিল ওয়িতরি ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা মুতাওয়াজ্জিহানইইলাজিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।

বিতর নামাজের নিয়ম:

 

অন্যান্য ফরজ নামাজের ন্যায় দুই রাকাআত নামাজ পড়ে প্রথম বৈঠকে বসে তাশাহহুদ পড়া। তারপর তৃতীয় রাকআত পড়ার জন্য উঠে সুরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য কোনো সুরা বা আয়াত মিলানো। কিরাআত (সুরা বা অন্য আয়াত মিলানোর পর) শেষ করার পর তাকবির বলে দু’হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে তাকবিরে তাহরিমার মতো হাত বাঁধতে হয়। তারপর নিঃশব্দে দোয়া কুনুত পড়া। দোয়া কুনুত পড়ে পূর্বের ন্যায় রুকু, সিজদার পর শেষ তাশাহহুদ, দরূদ, দোয়া মাছুরা পড়ে ছালাম ফিরানোর মাধ্যমে বিতরের নামাজ সমাপ্ত করতে হয়।প্রত্যেকটা বিষয় নিচে স্টেপ বাই স্টেপ দেওয়া হল:-

  • ফরজ এবং সুন্নত আদায় করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ুন।
  • উপরে উল্লেখিত নিয়মে নিয়ত করুন।
  • তাকবিরে তাহারিমা অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলে হাত হাত বাঁধন।
  • সানা, আউযুবিল্লাহ বিসমিল্লাহ সহিত সুরা ফাতেহা এবং একটি সূরা মিলান।
  • অতঃপর রুকু সিজদা গুলো অন্যান্য নামাজের ন্যায় পড়ুন ।
  • অতপর দাঁড়িয়ে আগের নেই সুরা ফাতেহা এবং অন্য একটি সূরা মিলান।
  • আবারো রুকু সিজদা গুলো অন্যান্যের ন্যায় আদায় করে এবার বসে পড়ুন।
  • এটা আপনার প্রথম বৈঠক। প্রথম বৈঠকে শুধু তাশাহুদ পড়ুন।
  • পুনরায় তাশাহুদ শেষ করে দাঁড়িয়ে পড়ুন।
  • বিসমিল্লাহ এর সাথে সূরা ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পড়ুন। এবং পুনরায় আবার আল্লাহু আকবার বলে হাত কান পর্যন্ত উঠে হাত বেঁধে ফেলুন।
  • এবার দোয়ায়ে কুনুত পড়ুন। 
  • এবার আল্লাহ আখবার বলে রুকু করুন। 
  • অন্যান্য নামাজের নেই আল্লাহু আকবার বলে দুই সেজদা আদায় করে বসে পড়ুন।
  • এবং এটাই আপনার (আখেরি) শেষ বৈঠক।
  • বসে তাশাহুদ, দরুদ শরীফ, দোয়ায়ে মাসুরা, পড়ুন।
  • সবশেষে আসসালামুয়ালাইকুম ও রাহমাতুল্লাহ বলে ডানে বামে সালাম ফিরিয়ে নিন।

দোয়া কুনুত আরবি ও বাংলা উচ্চারণ:
اللّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِيْ عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ، اللّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّيْ وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعٰى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشٰى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতাইনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা ওয়া নুমিনুবিকা ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা ওয়া নুছনি আলাইকাল খাইর; ওয়া নাশকুরুকা ওয়া লা নাকফুরুকা; ওয়া নাখলাঊ ওয়া নাতরুকু মাইঁইয়াফঝুরুকা; আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা না’বুদু; ওয়া লাকা নুসাল্লি ওয়া নাসঝুদু; ওয়া ইলাইকা নাসআ ওয়া নাহফিদু; নারঝু রাহমাতাকা ওয়া নাখশা আজাবাকা; ইন্না আজাবাকা বিলকুফফারি মুলহিক্ব।’

দোয়া কুনুত না পারলে কি পড়তে হবে?

 যদি কেউ দোয়ায়ে কুনুত না জানে সেক্ষেত্রে অতি দ্রুত শিখে ফেলতে হবে । এবং ওই সময়টায় রাব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়া ইলামতাগফিরলানা ওয়াতারহাম নালানা কুনান্না মিনাল খসিরিন অথবা যে কোন দোয়া পড়ে নেবে।

বিতর নামাজের সূরা :

বিতর নামাজের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সূরা নেই, বরং আপনি কোরআনের যে কোন সূরা থেকে অন্যান্য নামাজের মত পড়তে পারবেন।

বিতর নামাজ সম্পর্কে হাদিস :

বিতরের নামাজের এই পদ্ধতি হাদিস থেকে সুপ্রমাণিত হয় । রাসুলুল্লাহ (সা.)  বিতর তিন রাকাত পড়তেন এবং সাধারণত তাহাজ্জুদের পর বিতর পড়তেন। তিন রাকাতের দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদের জন্য বসতেন, কিন্তু সালাম ফেরাতেন না। সালাম ফেরাতেন সবশেষে তৃতীয় রাকাতে। 

আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, রমজানে নবীজির নামাজ কেমন হতো?উত্তরে  তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানে এবং রমজানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না! এরপর আরো চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তো বলাই বাহুল্য! এরপর তিন রাকাত (বিতর) পড়তেন। (সহিহ বুখারি : ১/১৫৪, হাদিস ১১৪৭; সহিহ মুসলিম : ১/২৫৪, হাদিস ৭৩৮; সুনানে নাসায়ি ১/২৪৮, হাদিস ১৬৯৭)।

সাদ ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, আয়েশা (রা.) তাকে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। (সুনানে নাসায়ি ১/২৪৮; হাদিস ১৬৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৪/৪৯৪, হাদিস ৬৯১২)।

ইমাম হাকেম (রহ.) হাদিসটি বর্ণনা করার পর বলেছেন, হাদিসটি বুখারি ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহিহ।

আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)ও এভাবে বিতর পড়তেন এবং তার সূত্রে মদিনাবাসীরা তা গ্রহণ করেছেন। (মুস্তাদরাক আলাস সহিহাইন ১/৩০৪, হাদিস : ১১৮১)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাহাজ্জুদ ও বিতর প্রত্যক্ষ করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এক রাতে তার খালা উম্মুল মুমিনিন মাইমুনা (রা.)-এর ঘরে অবস্থান করেন। তিনি যা যা প্রত্যক্ষ করেছেন তা বর্ণনা করেছেন, তার শাগরেদরা সে বিবরণ বিভিন্ন শব্দে বর্ণনা করেছেন। 

পরিশেষে :

বলা যাই যে , আমরা যথার্থ চেষ্টা করেছি বিতর নামাজের নিয়ত ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ একটি আর্টিকেল আপনাদের সাথে তুলে ধরার । আশা করি আজকের আর্টিকেলটি আপনাকে শুদ্ধভাবে বিতর নামাজ আদায় করতে সাহায্য করবে।

Write A Comment