আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছেন। হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠলে কিছু সময় পর যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে সেটি কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু যদি এটি ঘন ঘন হতে থাকে তাহলে চিন্তার বিষয় সেখানেই।তাই মাথা ঘোরা নিয়ে মাথাব্যথা না করে, মাথা ঘোরার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এটি কোনও রোগ নয়, অনেক রোগের উপসর্গহতে পারে।মাথা ঘোরা বা ভারটাইগো হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে মনে হয় আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই ঘুরছেন বা তার চারপাশটা ঘুরছে। মাথা তুলতেই পারেন না অনেকে। সঙ্গে থাকে বমি বমি ভাব ও বমি।
এই বিষয়ে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বলেছেন , হঠাৎ করে বসা, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়া, কাজের চাপ ইত্যাদি নানা কারণে অনেকের মাথা হঠাৎ করে ঘুরে উঠতে পারে।তাই মাথা ঘুরছে মনে হলেই কোথাও বসে পড়তে হবে অথবা হাত দিয়ে কিছু একটা ধরে ফেলুন। কিছুক্ষণ বসে থাকলে তা আবার ঠিকও হয়ে যায়। তাই এ নিয়ে কেউ খুব বেশি মাথা ঘামান না। তবে এটা ঠিক নয়।
মাথা ঘোরার কারণ ওপ্রতিকার :
মাথা ঘোরা এমন একটি সমস্যা যা প্রত্যেক ব্যক্তি অবশ্যই তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে অনুভব করেছে। এই অবস্থায়, ভারসাম্য হারিয়ে মাথা ঘুরতে শুরু করে, ফলে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মাথা ঘোরা কোনো রোগ নয়, বরং খারাপ স্বাস্থ্যের লক্ষণ।
কানের সমস্যা:
মাথা নাড়লেই মাথা ঘুরানো শুরু হয়। কিছু সময় পর পর এমন হলে বুঝতে হবে কানে সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যার নাম হচ্ছে বিনাইন পারঅক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো। আমাদের কানের ভিতরে থাকা ওটোলিথ (Otolith) স্থান পরিবর্তন করলে এই রোগটি হয়।
বিশেষ কিছু এক্সারসাইজ (epley maneuver) আছে সেগুলো নিয়মিত করলে এই সমস্যা সেরে যায়।
মিনিয়ার ডিজিস:
মাথা ঘোরার সাথে সাথে বমি এবং কথা শুনতে অসুবিধা হলেও বুঝতে হবে এজন্য কান দায়ী। এমন লক্ষণ থাকলে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এই রোগের রোগী সঠিক চিকিৎসা ও ওষুধের সাহায্যে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই সমস্যা মূলত অন্তঃকর্ণের সমস্যা।
ভারসাম্যহীন:
অ্যাকিউট ভাইরাস সেরেবেলিটিস হলেও বমি বমি ভাব ও মাথা ঘোরার মতো লক্ষণ দেখা যায়। আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থিত সেরিবেলাম (cerebellum) শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। সেরিবেলামে ভাইরাস সংক্রমণ হলে রোগী মাথা ঘুরে বা ভারসাম্য হারিয়ে পড়েও যেতে পারেন।
এই রকম হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত খেলে সমস্যা দূর হয়ে যায়।
স্পন্ডিলোসিস:
ঘাড়ে স্পন্ডিলোসিস হলে ঘাড়ের কাছ থেকে শিড়দাঁড়া ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। হাড়ের চাপ রক্তনালীতে পড়ে। ফলে মস্তিষ্কে রক্তের জোগান কমে যায়। যা থেকে মাথা ঘোরে।মূলত ঘাড় গুঁজে কাজ করা , এক্সারসাইজ না করা এই রোগের কারণ। এই রোগের উপসর্গ শুধু মাথা ব্যথা নয়, মাথা ঘোরাও একটি অন্যতম লক্ষণ।
এই রোগের প্রতিকার হিসেবে নিয়মিত যোগব্যায়াম বা নেক মাসেল এক্সারসাইজ করলে এই সমস্যা ধীরে ধীরে কমে যায়।
অ্যাটাক:
ট্র্যান্সিয়েনট ইসকেমিক অ্যাটাকের কারণে মস্তিষ্কে বা মেরুদণ্ডে রক্তের জোগান অনেক কমে যায়। আবার অনেক সময় স্ট্রোকের মতো উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়, হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠে।এই সমস্যার বিভিন্ন কারণ হয়ে থাকে । যেমন ডায়াবেটিস, ধমনীতে কোলেস্টরল জমা এবং হাইপারটেনশন।
কাজেই এই সমস্যা থেকে দূরে থাকতে হলে ওজন, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
মানসিক চাপ:
মানসিক চাপের পরিমাণ বেশি হলে মাথা ঘুরে ওঠে। মানসিক চাপ সামলাতে না পারলে অনেকেরই এই সমস্যা হয়ে থাকে।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে জীবনযাত্রাকে কঠিন অনুশাসনের মধ্যে রাখতে হবে।
ব্রেন টিউমার:
অ্যাকস্টিক নিউরোমা ব্রেন টিউমার হলেও অনেক সময় বমি ও মাথা ঘোরার মতো লক্ষণ দেখা যায়, তবে সব সময় এটা হয় না। নির্ভর করে টিউমার কোথায় হয়েছে তার উপর।
ভয় পেলে:
অনেকের রক্ত দেখলে মাথা ঘোরে ও আবার অনেকে মূর্ছা যান। আচমকা ভয় থেকে ব্লাড প্রেশার কমে গিয়ে এমন সমস্যা হয়ে থাকে ।
এমন হলে আক্রান্তকে শুইয়ে দিয়ে পা দু’টি উপর দিকে তুলে দিলেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে।
মাথা ঘোরা থেকে মুক্তির ঘরোয়া উপায়:
মাথা ঘোরা থেকে মুক্তির ঘরোয়া উপায়:
উপরোক্ত কারণ ছাড়া পানিস্বল্পতা, মোশন সিকনেস, মানসিক চাপ, হরমোনের পরিবর্তন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা হতে পারে। মাথাব্যথা, শ্বাস- প্রশ্বাসে অসুবিধা, দুর্বলতা,বমি অথবা বমি বমিভাব ইত্যাদি মাথা ঘোরার লক্ষণ। মাথা ঘোরার সমস্যা কমাতে কিছু ঘরোয়া উপায় নিম্নে দেয়া হলো –
১.পানি পান করুন:
পানিস্বল্পতার কারণে অনেক সময় মাথা ঘোরার সমস্যা হতে পারে ।এমন হলে পানি পান করুন। প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করুন। পাশাপাশি আপনি সামান্য মধু দিয়ে ভেষজ চা পান করতে পারেন। এ ছাড়া ও খেতে পারেন ফলের জুস।
২. কিছু খান:
রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গেলে, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে মাথা ঘোরার সমস্যা হয়ে থাকে । তাই এমন হলে স্বাস্থ্যকর কোনো স্ন্যাকস খান। এতে সমস্যা কমতে সাহায্য হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট রয়েছে এমন খাবার খেতে পারেন। যেমন : চকলেট, কলা খেতে পারেন। পাশাপাশি খেতে পারেন একমুঠো বাদাম । যেমন : কাঠবাদাম, ওয়ালনাট ইত্যাদি।
৩. আদা:
আদা বমি ও বমিভাব কমাতে উপকারী। এটি মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে, দ্রুত মাথা ঘোরার সমস্যা কমায়। তাই মাথা ঘোরার সমস্যা হলে এক টুকরো আদা চিবিয়ে খান। পাশাপাশি খেতে পারেন আদা চাও ।
৪. স্বাস্থ্যকর খাবার খান:
স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে স্নায়ু পদ্ধতিকে ভালো রাখে। এতে রক্তস্বল্পতা, রক্তচাপ কমে যাওয়া ইত্যাদি প্রতিরোধ হয়। এ ক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় আয়রন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ফলিস এসিড ও আঁশযুক্ত খাবার রাখুন।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম:
অনেক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হলেও মাথা ঘোরার সমস্যা হয়। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিন। প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান।
৬.লেবু :
লেবুতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি যা মাথা ঘোরাদূর করতে সাহায্য করে । লবণ দিয়ে লেবু চাটলে অথবা লেবু পানি খেতে পারেন।
৭.আমলার :
আমলা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং মাথা ঘোরা রোধ করে। আমলা ব্যবহার করতে, বীজগুলি সরিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন, ধনে গুঁড়ো যোগ করুন এবং সারারাত রেখে দিন। সকালে এই মিশ্রণটি ছেঁকে পান করলে ভার্টিগোর সমস্যা কমে যায়। মাথা ঘোরা উপশম না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি কয়েক দিন পুনরাবৃত্তি করুন।
মাথা ঘোরা কমানোর কিছু অন্যান্য উপায় অন্তর্ভুক্ত:
- মাথা ঘোরা হলে আরাম করে বসুন বা শুয়ে পড়ুন।
- মাথা ঘুরলে হাঁটার চেষ্টা করবেন না।
- সপ্তাহে একবার আপনার শরীর ম্যাসাজ করুন।
- গাড়িতে ভ্রমণ করার সময় যদি আপনি মাথা ঘোরা অনুভব করেন তবে তার পরিবর্তে অন্য কোনো পরিবহন ব্যবহার করুন।
- মাথা ঘোরা প্রতিরোধে যোগব্যায়াম কার্যকর।
- অ্যালকোহল, তামাক, ক্যাফেইন সেবন করবেন না কারণ এটি মাথা ঘোরার অবস্থা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- নিয়মিত ব্যায়াম করলে মাথা ঘোরার সমস্যা কমে।
- যখন আপনি মাথা ঘোরা অনুভব করেন, তখন শুয়ে পড়ুন এবং আপনার চারপাশের জিনিসগুলি দেখুন যাতে আপনি আপনার মনকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
আরো পড়ুন :শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তির উপায় এবং শাসকষ্ট হলে করণীয়।
পরিশেষে :
বলা যাই যে ,বেশিরভাগ মাথা ঘোরাই মারাত্মক নয়। যদিও মাথা ঘোরার কারণে স্ব্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে থাকে। তারপরও মাথা ঘোরা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, মাথা ঘোরার পেছনে মারাত্মক কিছু কারণ থাকতে পারে । আশা করছি এই আর্টিকেলটি আপনাকে মাথা ঘোরার সমস্যা থেকে সাহায্য করবে।