আসসালামু আলাইকুম আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।আমরা সামাজিক জীব। আর জীবনে চলার পথে আমাদের অনেক সময় নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলা করতে হয়ে থাকে। আর এগুলোর জন্য শারিরীক অসুস্থতার পাশাপাশি আমরা অনেক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ বা বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ি।
আমরা সকলেই নিজেদের শারিরীক স্বাস্থ্যের ব্যাপারের সচেতন হলেও অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে তেমন একটা খেয়াল রাখি না। তবে উভয় ধরনের সুস্থতা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
যদি আপনি মানসিকভাবে কিছুটা অসস্তি বোধ করেন এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজেন তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য ,এখানে বিস্তারত আলোচনা করা হয়েছে।
মানসিক রোগ কি:
মানসিক রোগ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরন ও জীবন-যাপনের চিত্র। এসময় মানুষ নানারকম মানসিক চাপ, অস্বস্তিতে ভোগেন এবং বিচলিত হয়ে পড়েন। এটা সাধারণত হয়ে থাকে মস্তিষ্কের রোগের কারণে। একজন মানসিক রোগির নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও পেশাগত জীবন অব্যাহত হয়।
মানসিক রোগের প্রকার :
মানসিক রোগকে মুলত দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে-
(১) নিউরোটিক
(২) সাইকোসিস
(১)নিউরোটিক:
এই ধরনের মানসিক রোগ হয় সাধারনত দুশ্চিন্তা, অস্বাভাবিক রাগ, ইন্টারনেট ও মাদকাসক্তি, প্যানিক, যৌন সমস্যা ইতাদি কারণে হয়ে থাকে । এই ধরনের মানসিক রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হয় ।
(২)সাইকোসিস:
এই রোগ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুতর মানসিক সমস্যা। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার ইত্যাদি কারণে সাইকোসিস মেন্টাল ডিজ-অর্ডার হয়ে থাকে।
মানসিক রোগ কেন হয় :
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষেরও বেশি এই ধরনের রোগের শিকার। মানসিক রোগের প্রকৃত কারণ এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয় নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত কয়েকটি কারণে মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে । সেগুলো হচ্ছে জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, শারীরিক ও মানসিক যৌন-নির্যাতন, পরিবেশগত প্রভাব,অস্বাভাবিকভাবে শিশুর লালন-পালন, দীর্ঘমেয়াদী অস্বাভাবিক চাপ, ইন্টারনেট সহ অন্যান্য নেশা দ্রব্যের প্রতি অধিক আগ্রহ, মস্তিষ্কের গঠন জনিত সমস্যা, নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, কিডনি, যকৃত, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব ইত্যাদি ।
এছাড়া ও মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস্, মাথায় আঘাত, ব্রেইন টিউমার, হৃদপিণ্ডের ফেইলিয়র ইত্যাদি মানসিক রোগের কারণ হয়ে থাকে।
মানসিক রোগের লক্ষণ :
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মেখলা সরকার বলেন, কোনো ব্যক্তির যখন আচরনের বড় ধরনের ও লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে আবেগ প্রকাশের সময় পরিবর্তন আসে এবং সেটা দৈনন্দিন কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলে তখন বুঝতে হবে সেই ব্যক্তি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ।
- বিশেষজ্ঞরা মানসিক রোগের কিছু লক্ষণ উল্লেখ করেছেন। সেগুলোহচ্ছে –
- টানা ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে বিষন্নতায় ভোগা।
- হঠাৎ করে কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
- পূর্বে ভালো লাগতো এমন কর্মকান্ডে আগ্রহ কমে যাওয়া।
- খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া।
- অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা।
- অনেকদিন যাবত নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখা।
- পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া।
- বিনাকারণে অন্যদেরকে সন্দেহ করা।
- সবার সাথে ঝগড়া বা বাগবিতন্ডায় জড়ানো।
- নিজের প্রতি উদাসীন থাকা এবং শারিরীক যত্ন না নেওয়া।
- অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা।
- সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা।
- গোসল করা, দাত ব্রাশ করার মতো নিয়মিত কাজে গাফিলতি করা।
- সময়মতো না ঘুমানো এবং ঘুমের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া।
উপরের এই লক্ষণগুলো যদি আপনার মাঝে অনুভব করে থাকেন তাহলে বুঝতে পড়বেন যে, আপনার মানসিক রোগ রয়েছে। এমতা অবস্থায় বিচলিত হওয়ার কোনোপ্রয়োজন নেই।অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগেরও চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।
মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়:
নানা রকম শারীরিক ও মানসিক রোগ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে।সকল মানুষ ও প্রাণীর মাঝে প্রাকৃতিকভাবেই কম-বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কারো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হয় আবার কারো ক্ষেত্রে কিছুটা কম, তবে সবার মাঝেই এটি আছে।এটা মানুষের জৈবিক গঠন, মানসিক গঠন ও সামগ্রিক মনোদৈহিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে।
অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বেশ কতগুলো উপায় রয়েছে । সেগুলো হলো-
(১) পরিস্থিতি এড়িয়ে না যাওয়া:
আমাদের জীবনে অনেক সময় অনেক ধরনের অপ্রীতিকর, কষ্টদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হয় আর আমরা সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাই এবং সেখান থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এই ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফ্যালে ।
এধরনের পরিস্থি এড়িয়ে না গিয়ে বরং সেটাকে মোকাবিলা করে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। এতে করে আমরা নিজেদের মাঝে একটা আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তি পেতে পারি
(২) বর্তমানে মনোযোগ দেওয়া:
আমরা, মানুষেরা স্বভাবতই অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে বেশি চিন্তা করতে থাকি। অতীতের নানা রকম পাওয়া, না-পাওয়ার হিসাব আমাদেরকে আফসোস করায়। এতে করে নানারকম দুশ্চিন্তাসৃষ্টি হয়।আবার ভবিষ্যতের নানাবিধ পরিকল্পনা আমাদেরকে বিচলিত করে তোলে। বর্তমান কাজে মননিবেশ করতে পারি না। এতে করে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি।
(৩) পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব:
মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম খুবই প্রয়োজন । পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই শরীর ও মন সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে মানসিক ক্লান্তি ও বিষাদও দূর হয়ে থাকে ।
(৪) মানুষকে সঙ্গ দেওয়া:
মানুষকে মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয় একাকিত্ব। মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করুন সবসময় ভালো মানুষদের সাথে থাকতে। সকলের সাথে হাসিখুশি আচরণ করলে এটা আপনাকে মানসিক তৃপ্তি দিবে এবং আপনি বিচলিত হবেন না বরং প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আপনাকে সাহায্য করবে ।
(৫) সৃজনশীল ও কর্মঠ হয়ে ওঠা:
সৃজনশীলতা মানুষকে নতুন কিছু সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আর মানুষ নিজে কিছু সৃষ্টি করতে পারলে তার আনন্দিত হয় এবং তৃপ্তি পায় । এতে করে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা সম্ভব এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়:
মানসিক রোগ আমাদের স্বাভাবিক জীবন চলার পথে একটি অন্যতম অন্তরায়। এটি নানাভাবে আমাদের দৈনন্দিন আনন্দের মুহূর্তগুলো নষ্ট করে দেয়।
উপরে উল্লিখিত মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়গুলোও মানসিক রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এগুলো ছাড়া কিছু উপায় হলো-
- অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া (এটা অধিক কার্যকরী)।
- বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে মেলামেশা করা।
- পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খাওয়ানিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো।
- ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করা।
- কাজে ব্যস্ত থাকা।
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- নিয়মমাফিক জীবন-যাপন করা।
- ধুমপান ও মাদক থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
আরো পড়ুন :মৌসুম পরিবর্তনে সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে মুক্তির ঘরোয়া উপায়।
পরিশেষে :
বলা যাই যে ,উপরের উল্লিখিত উপায়গুলো আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপাকারী হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন , আমাদের সবার মধ্যে কিছু কিছু আচরণের অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। সেটা হলেই সবাইকে মানসিক রোগী বলা যাবে না। কিন্তু তার এই মনের অবস্থার কারণে যদি তার স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে থাকে, তবে বুঝতে হবে যে, সে হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং পরামর্শ থাকবে দ্রুত ভালো ও অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার ।